প্রতিবেদন

বাংলাদেশের ই-কমার্স: ক্রমবিকাশ ও আস্থার নতুন দিগন্ত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে, যা দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়কালে এর প্রবৃদ্ধি বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো ছিল, তবে এর গতিপথের পেছনে আরও অনেক গভীর কারণ বিদ্যমান। বর্তমান সময়ে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ই-কমার্সের মাধ্যমে বেচাকেনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়।

পরিসংখ্যানের আয়নায় ই-কমার্সের অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার এবং প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই খাত একটি শক্তিশালী ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

২০১০ সালের দিকে যেখানে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার ছিল মাত্র কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০২৪ সালের মধ্যে এটি বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এটি কেবলমাত্র আর্থিক মূল্যের বৃদ্ধি নয়, বরং অনলাইন লেনদেনের সংখ্যা এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকেও একটি বিশাল উল্লম্ফন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে যেখানে অনলাইন লেনদেনের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫-৩০ মিলিয়ন, সেখানে ২০২৩ সালের মধ্যে তা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

ই-ক্যাবের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ২৮০০ এরও বেশি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষের বেশি ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। অনলাইন কেনাকাটায় ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি মোবাইল ব্যাংকিং (যেমন বিকাশ, রকেট, নগদ) এবং ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতির সহজলভ্যতা এই প্রবৃদ্ধিতে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ অনলাইন ক্রেতা এখনো ক্যাশ অন ডেলিভারি পছন্দ করেন, যা আস্থার প্রাথমিক স্তর তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। তবে, ডিজিটাল পেমেন্টের প্রতি মানুষের আস্থা ক্রমশ বাড়ছে।

মূল কেনাকাটার কত শতাংশ মানুষ অনলাইনে করে, তার সুনির্দিষ্ট জাতীয় পরিসংখ্যান এখনও তুলনামূলকভাবে কম হলেও, বিভিন্ন জরিপ এবং ডেটা বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায় যে, মোট খুচরা কেনাকাটার প্রায় ৭-১০ শতাংশ বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। এটি উন্নত দেশগুলোর (যেখানে ২০-২৫ শতাংশ বা তারও বেশি) তুলনায় কম হলেও, প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে এই হার ১৫-২০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে, অনলাইন কেনাকাটার প্রবণতা গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। তবে, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের প্রসার এবং ডেলিভারি নেটওয়ার্কের উন্নতির কারণে গ্রামীণ অঞ্চলেও ই-কমার্সের বিস্তার ঘটছে।

আস্থার সেতু বন্ধন: পূর্বে থেকে এখন কতটা ভিন্ন?
একসময় বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত ছিল আস্থার সংকটে জর্জরিত। পণ্য হাতে পাওয়ার আগে টাকা পরিশোধের ভয়, ভুল পণ্য ডেলিভারি, নিম্নমানের পণ্য, ডেলিভারিতে দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রতারণার ঘটনাগুলো ভোক্তাদের মনে অনলাইন কেনাকাটা সম্পর্কে এক ধরনের অনীহা তৈরি করেছিল। তবে, গত কয়েক বছরে এই চিত্র অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রথমত, আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর উন্নতি হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এবং ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা, ২০২০ প্রণয়নের ফলে ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে এবং প্রতারণার শিকার হলে আইনি প্রতিকারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ই-ক্যাব এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড মেনে চলতে উৎসাহিত করছে এবং বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করছে। এতে করে গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের ভরসা তৈরি হয়েছে যে, তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত আছে।

দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দারাজ, আজকেরডিল, চালডাল, অথবা ফুডপান্ডার মতো বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো সফলভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা পরিচালনা করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে। তারা মানসম্মত পণ্য সরবরাহ, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি এবং সহজ রিটার্ন/রিফান্ড নীতি অনুসরণ করে গ্রাহকদের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা দিয়েছে। এ ছাড়াও, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য ও বিক্রেতার রিভিউ এবং রেটিং সিস্টেম গ্রাহকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং বিশ্বস্ত বিক্রেতা নির্বাচন করতে সহায়তা করছে। ভালো রিভিউগুলো নতুন গ্রাহকদের আস্থা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তৃতীয়ত, পেমেন্ট গেটওয়ে এবং ডেলিভারি পদ্ধতির উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক এবং মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন বিকাশ, রকেট, নগদ) নিরাপদ অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা করেছে, যা লেনদেনের ঝুঁকি কমিয়েছে। পাশাপাশি, পাঠাও ডেলিভারি, ই-কুরিয়ার, রেডএক্স, অথবা সুন্দরবন কুরিয়ারের মতো তৃতীয় পক্ষের লজিস্টিকস কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডেলিভারি প্রক্রিয়া আরও দ্রুত, নির্ভরযোগ্য এবং সুদূর প্রসারী হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন অনলাইন পণ্য ডেলিভারি সম্ভব হচ্ছে, যা পূর্বে অকল্পনীয় ছিল।

এ ছাড়াও, বিক্রেতাদের পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি, গ্রাহক সেবায় বিনিয়োগ এবং দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রবণতা আস্থার পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, পূর্বে যেখানে ই-কমার্স ছিল এক অনিশ্চিত যাত্রা, সেখানে বর্তমানে তা অনেকটাই নির্ভরযোগ্য এবং আস্থার একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যদিও এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ (যেমন- নকল পণ্যের উপস্থিতি বা নির্ধারিত সময়ের বাইরে ডেলিভারি) বিদ্যমান, তবে আস্থার জায়গাটি অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সুদৃঢ় হয়েছে, যা গ্রাহকদের অনলাইন কেনাকাটার প্রতি উৎসাহিত করছে।

অনলাইনে যেসকল আইটেম বেশি কেনাবেচা হচ্ছে
বাংলাদেশের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনাবেচা হলেও কিছু নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির পণ্যের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই ক্যাটাগরিগুলো ই-কমার্সের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে:
ফ্যাশন ও পোশাক: এটি বাংলাদেশের ই-কমার্সের অন্যতম বৃহৎ এবং দ্রুত বর্ধনশীল একটি খাত। টি-শার্ট, শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, জুতো, গহনা এবং অন্যান্য ফ্যাশন অনুষঙ্গ অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয়। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব কেন্দ্রিক পোশাক, ট্রেন্ডি ডিজাইন এবং ব্র্যান্ডেড পণ্যের সহজলভ্যতা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। তরুণ প্রজন্ম ফ্যাশন পণ্যের জন্য অনলাইনে বেশি নির্ভরশীল।

ইলেকট্রনিক্স ও গ্যাজেটস: মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কমপিউটার এক্সেসরিজ, হেডফোন, স্মার্টওয়াচ, ক্যামেরা এবং অন্যান্য গ্যাজেট অনলাইন ক্রেতাদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। ব্র্যান্ডেড পণ্যের ওয়ারেন্টি, তুলনামূলক কম দাম (বিশেষ করে ডিসকাউন্ট অফার), এবং ঘরে বসে পণ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকায় ক্রেতারা এই ধরনের পণ্য অনলাইনে কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

বই ও স্টেশনারি: বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যবই, গল্পের বই, উপন্যাস, রেফারেন্স বই এবং অফিস স্টেশনারি অনলাইনে সহজলভ্য হওয়ায় বইপ্রেমী ও শিক্ষার্থীরা অনলাইনে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। অনেক সময় নতুন বইয়ের প্রি-অর্ডার এবং বিশেষ ছাড়ের সুবিধা থাকে।

স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য পণ্য: কসমেটিকস, ত্বকের যত্নের পণ্য, চুলের যত্নের সামগ্রী, স্বাস্থ্য পরিপূরক, এবং ব্যক্তিগত যত্নের সামগ্রী অনলাইনে বেশ চাহিদা তৈরি করেছে। নারীরা এই ধরনের পণ্যের জন্য অনলাইনে বেশি নির্ভর করেন, কারণ এখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের সহজলভ্যতা এবং তুলনা করার সুযোগ থাকে।

খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য (গ্রোসারি): বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে অনলাইন গ্রোসারি শপগুলোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি থেকে শুরু করে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন অনলাইনে অর্ডার করা সম্ভব। কর্মব্যস্ত মানুষ এবং প্রবাসীরা তাদের পরিবারের জন্য প্রায়শই এই পরিষেবা ব্যবহার করেন।

গৃহস্থালি পণ্য ও সজ্জা সামগ্রী: ছোট রান্নাঘরের সরঞ্জাম, ডেকোরেশন সামগ্রী, ক্রোকারিজ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপকরণ, এবং গৃহস্থালি ব্যবহারের অন্যান্য ছোটখাটো জিনিসপত্র অনলাইনে ভালো বিক্রি হচ্ছে।

বাচ্চাদের খেলনা ও সামগ্রী: শিশুদের পোশাক, খেলনা, ডায়াপার, ফিডিং বোতল, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনলাইনে ব্যাপক হারে বিক্রি হয়। বাবা-মায়েরা প্রায়শই শিশুদের পণ্য অনলাইনে কেনেন কারণ এটি সময় বাঁচায় এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য তুলনা করার সুযোগ দেয়।

এ ছাড়াও, ফার্নিচার, স্পোর্টস সরঞ্জাম, অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ, এবং কারিগরী পণ্যের মতো বিশেষায়িত পণ্যের ক্ষেত্রেও অনলাইনে একটি নির্দিষ্ট ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রসারের সাথে সাথে এই পণ্যগুলোর বিক্রিও বাড়ছে।

বাংলাদেশের ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ: এক উজ্জ্বল দিগন্ত
প্রচারিত হচ্ছে মানুষ প্রতিনিয়ত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, এবং ভালো দিকগুলো বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু চালিকাশক্তি এই ইতিবাচক ধারাকে আরও ত্বরান্বিত করবে:
ব্যাপক ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহার: বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি এবং স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফোর-জি নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ এবং ফাইভ-জি চালুর পরিকল্পনা অনলাইন কেনাকাটার অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করবে এবং ই-কমার্সের প্রবেশাধিকারকে আরও সহজ করে তুলবে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে।

ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল পেমেন্ট এবং ফিনটেক বিপ্লব: মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস যেমন বিকাশ, রকেট, নগদ-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের সহজলভ্যতা মানুষকে ক্যাশলেস লেনদেনে উৎসাহিত করছে। ফিনটেক কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবন অনলাইন পেমেন্টকে আরও নিরাপদ, দ্রুত এবং সুবিধাজনক করে তুলবে, যা ই-কমার্সের প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।

সহজলভ্য লজিস্টিকস ও ডেলিভারি নেটওয়ার্ক: ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ডেলিভারি নেটওয়ার্কের পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষের লজিস্টিকস সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা দেশে দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি নিশ্চিত করতে নতুন নতুন হাব এবং আধুনিক ডেলিভারি পদ্ধতি (যেমন ড্রোন ডেলিভারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা) চালু হচ্ছে। এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ই-কমার্সের প্রসার ঘটাচ্ছে।

সরকারি সহযোগিতা ও নীতিমালা: সরকার ই-কমার্স খাতের বিকাশে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রণয়নে কাজ করছে। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন এবং ই-কমার্সের জন্য বিশেষ কর সুবিধা (যদি প্রযোজ্য হয়) অনলাইন ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করছে। সরকার ডিজিটাল রুপান্তর ভিশন বাস্তবায়নে ই-কমার্সকে একটি মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশাল সুযোগ: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য তাদের পণ্য বিক্রির একটি বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে। ফেসবুক কমার্স, ছোট ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস এসএমইগুলোকে সহজে এবং কম খরচে তাদের পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করছে। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

উপভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন: ভোক্তারা ধীরে ধীরে অনলাইন কেনাকাটার সুবিধা (যেমন- সময় ও শ্রম সাশ্রয়, পণ্যের বৈচিত্র্য, ২৪/৭ কেনাকাটার সুযোগ এবং প্রতিযোগিতামূলক দাম) সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন এবং এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠছে। বিশেষ করে শহুরে জীবনে, ব্যস্ততার কারণে অনলাইন কেনাকাটা একটি পছন্দের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিশ মার্কেট এবং বিশেষায়িত প্ল্যাটফর্মের উদ্ভব: শুধু সাধারণ পণ্য নয়, বর্তমানে বিশেষায়িত পণ্য এবং সার্ভিসের জন্য আলাদা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, হাতে তৈরি পণ্য, অর্গানিক ফুড, আর্টওয়ার্ক বা নির্দিষ্ট কোনো সেবার জন্য বিশেষায়িত প্ল্যাটফর্মগুলো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পণ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে এবং বাজারের পরিধি বাড়াচ্ছে।

তবে, এই অগ্রগতির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভোক্তা অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করা, নকল পণ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া, পণ্য ফেরতের জটিলতা কমানো এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুত ও সাশ্রয়ী ডেলিভারি নিশ্চিত করা। এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারলে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে এবং দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এটি কেবল বেচাকেনার একটি মাধ্যম নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা আগামী দিনে দেশের বাণিজ্যিক ল্যান্ডস্কেপের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *