বাংলাদেশের আকাশে ডানা মেলছে স্টারলিংক: ডিজিটাল সংযোগের নতুন দিগন্ত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশের ডিজিটাল ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, গত ২৮ এপ্রিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে স্পেসএক্স-এর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিস স্টারলিংক-এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়ার মাধ্যমে। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাল, যা ডিজিটাল সংযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।
প্রচলিত সমস্যা এবং স্টারলিংকে সমাধান
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ডিজিটাল বৈষম্য এবং দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকাগুলোতে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের অভাব এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রায়শই বিঘ্নিত হয়। বর্তমানে দেশের প্রায় ৬৫% টেলিকম টাওয়ার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের বাইরে। এই ধরনের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সরবরাহের পথে একটি বড় বাধা।
স্টারলিংক এই সমস্যাগুলোর একটি কার্যকর সমাধান নিয়ে এসেছে। স্যাটেলাইট-ভিত্তিক এই প্রযুক্তি সরাসরি মহাকাশ থেকে সংকেত সরবরাহ করে, তাই এটি স্থলভাগের অবকাঠামো, যেমন—ফাইবার অপটিক ক্যাবল বা মোবাইল টাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল নয়। এর ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, জুলাই বিপ্লবের সময় বারবার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার পর নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের যে ব্যাপক চাহিদা ছিল, স্টারলিংকের অনুমোদন তারই ফল। এই পরিষেবা দুর্গম হাওর অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, দ্বীপ এবং দুর্যোগ-প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলের মতো স্থানগুলোতেও উচ্চ-গতির এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট নিশ্চিত করবে।
ই-কমার্স এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ে নতুন সম্ভাবনা
স্টারলিংকের সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা যাবে ই-কমার্স এবং ফ্রিল্যান্সিং খাতে। প্রত্যন্ত ও গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চ-গতির এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেটের অভাবে এতদিন এই খাতগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হতে পারেনি। স্টারলিংকের আগমনে এই চিত্র বদলে যাবে।
ই-কমার্সের প্রসার: প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট উদ্যোক্তা ও কৃষকরা এখন সহজেই তাদের পণ্য অনলাইনে বিক্রি করতে পারবেন। নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারবেন, যা মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরতা কমাবে। এতে দেশের ই-কমার্স বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে এবং গ্রামের অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ: দেশের প্রায় ৮ লাখ ফ্রিল্যান্সারের জন্য স্টারলিংকের আগমন একটি গেম-চেঞ্জার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট লরেন ড্রেয়ার-এর সঙ্গে আলোচনায় স্টারলিংকের পাশাপাশি পেপ্যাল-এর মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে আনার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। দ্রুত ও স্থিতিশীল ইন্টারনেট এবং আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সলিউশনের সমন্বয় ফ্রিল্যান্সারদের বৈশ্বিক বাজারে আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ করে দেবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সামনের পথ
স্টারলিংকের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অসীম হলেও এর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাশ্রয়ী মূল্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্টারলিংকের পরিষেবা তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। জানা গেছে, বাংলাদেশে এর মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি এবং হার্ডওয়্যার খরচ সাধারণ মানুষের জন্য বেশ বেশি হতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং স্টারলিংক যৌথভাবে একটি সাশ্রয়ী ট্যারিফ প্ল্যান তৈরির কাজ করছে। ভর্তুকি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) অথবা কমিউনিটি-ভিত্তিক অ্যাক্সেস মডেলের মতো কৌশল ব্যবহার করে খরচ কমানো সম্ভব হতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং দুর্গম অঞ্চলের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে পরিষেবা দেয়া গেলে এর সুফল সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর নতুন ‘নন-জিওস্টেশেনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর’ সংক্রান্ত নীতিমালা এই ধরনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তির জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ উদ্ভাবনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত এবং ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দিতে বদ্ধপরিকর। স্টারলিংকের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে উচ্চ-গতির ইন্টারনেট পৌঁছালে তা কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিই ঘটাবে না, বরং দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন আর মাটিতে সীমাবদ্ধ নয়, তা আকাশে ডানা মেলছে।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব