সাম্প্রতিক সংবাদ

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আইসিটি খাত সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া

ক.বি.ডেস্ক: এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিগত বছরের বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এবারের বাজেটে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

গতকাল সোমবার (২ জুন) ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ প্রতিপাদ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ও বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫৪তম ‘২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট’ উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এবার মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়। এই বাজেট প্রস্তাব পাস হবে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।

২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আইসিটি খাতে বরাদ্দ কমিয়ে রাখা হয়েছে ১৭ হাজার ৩৯৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১ লাখ ২১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। তবে টেলিকম খাতে আগের বছরের (২০২৪–২৫ অর্থবছরের ) সংশোধিত বাজেট থেকে বরাদ্দ কমেছে ২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। টেলিকম খাতে এবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৯০৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে কমপিউটার মনিটরের উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত কমপিউটার মনিটরের উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের জন্য আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা রয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের টার্নওভার করের পরিমাণ ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

দেশের ইন্টারনেট খাতের জন্য বিশেষ কিছু নেই। ছোট ও মাঝারি আইএসপি ব্যবসায়ীদের জন্য কোনও সুখবর নেই
মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম- সভাপতি, আইএসপিএবি

প্রস্তাবিত বাজেটে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হলেও সিমের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশই বলবৎ রয়েছে। অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এর ফলে অনলাইন কেনাকাটায় খরচ বাড়বে। কসমেটিকস সামগ্রীর শুল্কায়নে ন্যূনতম মূল বাড়ানোর প্রস্তাব করায় ই-কমার্সে এসব নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন সেই উদ্যোক্তারাও চাপে পড়বেন। ইন্টারনেট সেবা থেকে উৎসে কর কর্তনের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হলেও এর প্রভাব প্রান্তিক পর্যায়ে খুব একটা পড়বে না।

তবে সার্বিক বিবেচনায় প্রস্তাবিত বাজেটে আশাহত হয়েছেন দেশের আইসিটি খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, বাজেটে ব্যবসায় পর্যায়ের কর ও শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব মূলতঃ ভোক্তা পর্যায়েই চাপ বাড়বে। করপোরেট ব্যবাসয়ীরা সুযোগ পেলেও ক্ষুদ্র ও কুটির উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে কোনো সুখবর নেই। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন…..

বিসিএস’র আগামীর সভাপতি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, “হার্ডওয়্যার নির্মাতাদের জন্য আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে আসন্ন বাজেটে। ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এই খাতে খুব সামান্য প্রভাব ফেলবে। তবে এসআরও খুঁজে এখনও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সুখবর পাইনি।”

অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে এখন তারা বিদেশী ওটিটি’র কাছে মার খাবে
সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক- জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, আইএসপিএবি

আইএসপিএবি’র সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বলেন, “এবারের বাজেট গতানুগতিক। দেশের ইন্টারনেট খাতের জন্য বিশেষ কিছু নেই। ছোট ও মাঝারি আইএসপি ব্যবসায়ীদের জন্য কোনও সুখবর নেই। আগে যা ছিল এখনও তাই আছে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী যারা আছেন তারা শতভাগ দেশীয় উদ্যোক্তা। তবে করপোরেট ব্যবহারকারীদের যারা ইন্টারনেট সেবা দেয় তারা কিছুটা সুফল পেতে পারে। কারণ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) কেটে রেখে বিল পরিশোধ করে। এআইটি ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করায় স্বল্প সংখ্যক আইএসপি কিছুটা সুবিচার পেতে পারে। সরকার ইন্টারনেটের মূল্য কমাতে চায়। কিন্তু ভ্যাট, ট্যাক্সে হাত দেবে না, ইকুইপমেন্টের মধ্যে হাত দেবে না। ফলে কোনও লাভ হবে না। ভ্যাট, ট্যাক্সে হাত না দিলে ইন্টারনেটের মূল্য কমবে না।”

আইএসপিএবি’র জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি সাইফুল ইসলাম সিদ্দিক বলেন, “মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশীয় ওটিটি গড়ে ওঠেছে। অনলাইন স্ট্রিমিং ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে এখন তারা বিদেশী ওটিটি’র কাছে মার খাবে। দেশে জনপ্রিয় হলেও বিদেশী ওটিটি থেকে কিন্তু সরকার সেভাবে কোনো আয়ও পায় না। এ ক্ষেত্রে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলে এটি বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মেরই প্রমোট করা হবে। যারা চরকি দেখছে তাদের ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে। আবার যারা সনিলিভ দেখছেন তাদের সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ পড়ছে না। এই শুল্ক ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবসার ওপর নতুন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেশীয় ওটিটি ইন্ডাস্ট্রির বিকাশের জন্য শুরুতে দেশীয় ওটিটি প্লাটফর্মগুলোকে শুল্ক মুক্ত হওয়া উচিত।”

দেশে উৎপাদিত ও সংযোজিত মোবাইল ফোনের মূল্য বাড়বে। ওটিটির ওপর শুল্ক আরোপ করায় দেশী ওটিটিগুলো চাপে পড়বে
এ কে এম ফাহিম মাশরুর- সাবেক সভাপতি, বেসিস

বাক্কো’র সভাপতি তানভীর ইব্রাহিম বলেন, “বাজেট প্রস্তাবনা আইসিটি গ্রোথ ফ্রেন্ডলি মনে হয়নি। এখনও এই খাতটির ওপর পুরো ফোকাস করা হয়নি। অথচ অন্যন্য সব খাতই এখন কোনও না কোনও ভাবে আইসিটি ব্যবহার করে। তাই এই খাতে আরও সুদৃষ্টি দেয়া দরকার। ইন্টারনেট, ডিজিটাল ডিভাইস সবার কাছে সুলভ করার পাশাপাশি বিপিও ব্যবসায় প্রসারে বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার।”

ই-কমার্সের ক্রেতারা অনিয়ন্ত্রিত ফেসবুকভিত্তিক কমার্সের দিকে ঝুঁকবেন; ফলে সরকার রাজস্ব হারাবে
সৈয়দ আলমাস কবির- সাবেক সভাপতি, বেসিস

বেসিস’র সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, “ইন্টারনেটের ওপর এআইটি কমানো ভালো সিদ্ধান্ত। এতে সেবার মান বাড়াতে কিছুটা সক্ষম হবে আইএসপিগুলো। অনলাইনে বিক্রির ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করায় অনলাইনে কেনাকাটায় উৎসাহে ভাটা পড়বে। ই-কমার্স-এর ক্রেতারা অনিয়ন্ত্রিত ফেসবুক-ভিত্তিক কমার্সের দিকে ঝুঁকবেন; ফলে সরকার রাজস্ব হারাবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বেড়েছে গত বছরের সংশোধিত বাজেট থেকে। তবে, সঠিক প্রকল্পে খরচ এবং তার নিয়মিত যাচাই প্রয়োজন। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে অনুদান খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। তবে ৪৯২টি প্রকল্পের জন্য মাত্র ১৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা খুবই অপ্রতুল। আরঅ্যান্ডডি উৎসাহিত করার জন্য কোম্পানীগুলোকে কর রেয়াত দিতে হবে। তাহলে কোম্পানীগুলো আরঅ্যান্ডডি-তে ব্যয় বাড়াবে এবং তারাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুদান দেবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন ভালো সিদ্ধান্ত। তবে, স্টার্টআপ ফান্ড আগেও ছিল, যদিও ন্যায়সঙ্গতভাবে সেই টাকা বিনিয়োগ করা হয়নি।”

ইন্টারনেট, ডিজিটাল ডিভাইস সবার কাছে সুলভ করার পাশাপাশি বিপিও ব্যবসায় প্রসারে বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার
তানভীর ইব্রাহিম- সভাপতি, বাক্কো

বেসিস’র সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, “আমরা বরাবরই ইন্টারনেটের মূল্য কমানোর জন্য বলে আসছি। মোবাইল ফোন ও ডেটার মূল্য কমাতে বাজেটে সিম ট্যাক্স প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু এবারের বাজেটে তা করা হয়নি। সিমের ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক থাকায় প্রস্তাবিত বাজেটে ডেটার মূল্য কমার বিষয়টি প্রাধান্য পেলো না। গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট মূল্য কমার কোনো সম্ভাবনাই নেই। উপরন্তু মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কিছুটা হ্রাসপূর্বক মেয়াদ ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। ফলে দেশে উৎপাদিত ও সংযোজিত মোবাইল ফোনের মূল্য বাড়বে। এতে ডিজিটাল ডিভাইস বাড়বে। ওটিটির ওপর শুল্ক আরোপ করায় দেশী ওটিটিগুলো চাপে পড়বে। ইকমার্স প্লাটফর্মে কেনাকাটায় গ্রাহক আগ্রহ হারাবে। অনলাইন কেনাবেচা ফেসবুকমুখী হবে। এতে দেশীয় উদ্যোক্তা সুরক্ষার প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হবে না।

তবে এসআরও খুঁজে এখনও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সুখবর পাইনি
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম- সভাপতি (সম্ভাব্য), বিসিএস

ই-ক্যাব’র সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাহাব উদ্দিন শিপন বলেন, “ই-কমার্স খাত আবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাজেটে একাধিক কর বৃদ্ধি প্রস্তাব এসেছে। ফলে উদ্যোক্তা, বিক্রেতা এবং গ্রাহক তিন পক্ষের ওপরই সরাসরি প্রভাব ফেলবে। বাজেট প্রস্তবনা কার্যকর হলে ই-কমার্স খাতে কমিশনের উপর ভ্যাট তিনগুণ বৃদ্ধি হবে। বর্তমান ৫% । প্রস্তাবিত ১৫% । এতে অনলাইন ব্যাবসা আর্থিক চাপ বাড়বে। বিক্রেতাদের মুনাফা কমবে অথবা গ্রাহকদের থেকে বাড়তি মূল্য নিতে হবে।”

কৃতজ্ঞতায়: ডিজিবাংলাটেক ডট নিউজ

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *