সাম্প্রতিক সংবাদ

প্রযুক্তি পণ্যে এমআরপি: ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রতিটি পণ্যের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (Maximum Retail Price – MRP) উল্লেখ করা থাকে। এই সহজ নিয়মটি একদিকে যেমন ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করে, তেমনি অন্যদিকে একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন মূল্য থেকে সৃষ্ট প্রতারণাও প্রতিরোধ করে। কিন্তু আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা প্রযুক্তি পণ্যের ক্ষেত্রে এই নিয়মটি অনুপস্থিত।

কমপিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, প্রযুক্তি পণ্যের অন্যান্য আনুষাঙ্গিক পন্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট এমআরপি না থাকায় ক্রেতারা প্রায়শই একই পণ্য ভিন্ন ভিন্ন দোকানে ভিন্ন মূল্যে ক্রয় করে প্রতারিত হচ্ছেন বা ঠকছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং ভোক্তাদের অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রযুক্তি পণ্যে এমআরপি থাকার বাধ্যবাধকতা কেন জরুরি, আজকের আলোচনা সে বিষয়েই।

এমআরপি: ভোক্তাদের সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রতীক
এমআরপি মূলত ভোক্তাদের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি থেকে রক্ষা করার জন্য একটি সুরক্ষাকবচ। যখন একটি পণ্যের গায়ে এমআরপি মুদ্রিত থাকে, তখন বিক্রেতা সেই মূল্যের বেশি মূল্যে পণ্যটি বিক্রি করতে পারেন না। এটি পণ্যের মূল্য নিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং ক্রেতাকে সঠিক মূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ দেয়। বিশেষ করে, যেখানে পণ্যের সরবরাহ সীমিত বা চাহিদা বেশি, সেখানে বিক্রেতাদের ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণের প্রবণতা রোধ করতে এমআরপি অত্যন্ত কার্যকর। এই ব্যবস্থা ভোক্তাকে প্রতারণা থেকে বাঁচায় এবং তাদের আস্থা বাড়ায়, যা সামগ্রিকভাবে বাজারের স্থিতিশীলতা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে।

প্রযুক্তি পণ্যে এমআরপি না থাকার কারণ ও প্রভাব
প্রশ্ন ওঠে, অন্যান্য পণ্যে এমআরপি থাকলেও প্রযুক্তিপণ্যে কেন নয়? এর পেছনে কয়েকটি কারণ প্রচলিত- প্রযুক্তি পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, ডলারের বিনিময় হার, নতুন মডেলের আগমন এবং প্রযুক্তিগত আপগ্রেডের কারণে দ্রুত পরিবর্তিত হয়। এ ছাড়া, আমদানিকারক, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতার স্তরে বিভিন্ন ভ্যাট, শুল্ক ও লজিস্টিক খরচ যুক্ত হয়, যা চূড়ান্ত মূল্যে প্রভাব ফেলে। বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য ছাড় বা বান্ডেল অফারও দেন, যা এমআরপি থাকলে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে, এসব যুক্তি গ্রাহকের প্রতারিত হওয়ার অভিজ্ঞতাকে আড়াল করতে পারে না। এমআরপি না থাকার কারণে যা ঘটে…..

মূল্য বৈষম্য: একই পণ্যের মূল্য বিভিন্ন দোকানে ভিন্ন ভিন্ন হয়, ফলে ক্রেতা না জেনে বেশি মূল্যে ক্রয় করে প্রতারিত হন।
প্রতারণা ও অতিরিক্ত মুনাফা: কিছু অসাধু বিক্রেতা কৃত্রিম সংকট বা ভুল তথ্য দিয়ে চড়া মূল্যে বিক্রি করেন।
তথ্যের অভাব: ক্রেতারা পণ্যের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে অবগত না থাকায় দর কষাকষি বা তুলনামূলক যাচাইয়ের সুযোগ হারান।
আস্থার সংকট: বাজারের স্বচ্ছতা না থাকায় বিক্রেতাদের প্রতি ক্রেতাদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়।
ওয়ারেন্টি ও সেবার জটিলতা: নিম্নমানের বা ত্রুটিপূর্ণ পণ্য কম মূল্যে বিক্রির পর ওয়ারেন্টি বা সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি দেখা যায়।

বাংলাদেশের আইন ও প্রযুক্তি পণ্য: ভোক্তার অধিকার রক্ষার সুযোগ
বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় শক্তিশালী আইনি কাঠামো দিয়েছে। এই আইনের ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে, “কোনও ব্যক্তি পণ্যের মোড়কে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (Maximum Retail Price) উল্লেখ না করিয়া বা উহার অধিক মূল্যে পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করিলে অনধিক এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।”

যদিও এই ধারায় সরাসরি প্রযুক্তি পণ্যের কথা উল্লেখ নেই, তবে “পণ্য” শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে অবশ্যই কমপিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্মার্টফোন বা যেকোনও ইলেকট্রনিক পণ্য অন্তর্ভুক্ত। আইনের উদ্দেশ্যই হলো মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনা এবং ভোক্তাকে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ থেকে রক্ষা করা। যদি কোনও পণ্যের মোড়কে এমআরপি না থাকে বা তার চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করা হয়, তবে তা এই আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ ছাড়া, আইনের ৩৮ ধারায় পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও, প্রযুক্তি পণ্যের দোকানে এর অনীহা দেখা যায়, যা আইনের লঙ্ঘন। এই আইনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রযুক্তি পণ্যের ক্ষেত্রেও এমআরপি বা অন্তত একটি নির্ধারিত খুচরা মূল্য থাকা উচিত, যা বিক্রেতাদের একটি সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করবে।

এমআরপি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও ব্যবহারিক সমাধান: প্রযুক্তি পণ্যে এমআরপি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও, কার্যকর সমাধানের মাধ্যমে তা সম্ভব।

প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ: আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত মূল্য পরিবর্তনশীলতা। বিভিন্ন স্তরের শুল্ক ও ভ্যাটের কারণে চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণের জটিলতা। বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক ছাড়ের প্রবণতা। বিভিন্ন মডেল ও কনফিগারেশনের কারণে মূল্যে ভিন্নতা।

ব্যবহারিক সমাধানের উপায়সমূহ
ফ্লোর প্রাইস (Floor Price) ও প্রস্তাবিত খুচরা মূল্য (SRP) নির্ধারণ: কঠোর এমআরপি-এর পরিবর্তে একটি সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য (Floor Price) এবং একটি প্রস্তাবিত খুচরা মূল্য (Suggested Retail Price – SRP) নির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে বিক্রেতারা ন্যায্য লাভের মার্জিন রেখে মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন, তবে অতিরিক্ত মূল্য চাপানোর সুযোগ থাকবে না।

প্রযুক্তিগত অনলাইন ডেটাবেস: প্রতিটি প্রযুক্তি পণ্যের প্রস্তাবিত খুচরা মূল্য ও তার সর্বশেষ আপডেট সম্বলিত একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন ডেটাবেস তৈরি করা যেতে পারে। ক্রেতারা সহজেই স্মার্টফোনের মাধ্যমে মূল্য যাচাই করতে পারবেন।

শুল্ক ও ভ্যাট কাঠামোর সরলীকরণ: আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ও ভ্যাট কাঠামোকে সরলীকরণ করলে পণ্যের চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারণ সহজ হবে।

কর্তৃপক্ষ ও বিক্রেতাদের আলোচনা: জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, আমদানিকারক, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতারা মিলে একটি কার্যকর মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারেন।

ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি: গ্রাহকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন, যাতে তারা নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ না করেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস) ২০১৮ সালে কমপিউটার ও কমপিউটারের খুচরা আনুষাঙ্গিক পণ্যের ওপর ‘এমআরপি নীতিমালা ২০১৮’ এবং ‘ওয়ারেন্টি নীতিমালা ২০১৮’ কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছিলো, যা ২০১৮ সালের ২২ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিলো। এতে বলা হয়েছিলো, মেলা বা প্রদর্শনীতে দেয়া ছাড় সারা দেশের বাজারেও প্রযোজ্য হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই নীতিমালার বাস্তবিক প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায়নি, যা বাজারের বর্তমান অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ।

প্রযুক্তি পণ্য এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এমআরপি না থাকায় এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে ভোক্তাদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ রয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর বিদ্যমান ধারাগুলো বিশ্লেষণ করে এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে প্রযুক্তিপণ্যে একটি যৌক্তিক ও কার্যকর মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি (যেমন- SRP বা ফ্লোর প্রাইস) চালু করা এখন সময়ের দাবি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, প্রযুক্তি পণ্য আমদানিকারক, পরিবেশক, বিক্রেতা এবং ভোক্তা প্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি টেকসই সমাধান বের করা সম্ভব। এটি কেবল ভোক্তার অধিকারই নিশ্চিত করবে না, বরং ডিজিটাল রুপান্তর গড়ার পথে একটি শক্তিশালী ও স্বচ্ছ বাজার অর্থনীতি গঠনেও সহায়ক হবে। প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ভোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিই উপকৃত হবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *