অন্যান্য মতামত

নেতৃত্বহীনতার এক বছর: সংকটের আবর্তে ই-ক্যাব

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ই-কমার্স খাত বর্তমানে এক রূপান্তরকারী শক্তি, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক সময়ে প্রায় ২৫ শতাংশ। এই খাত লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরি করেছে এবং ২০ লাখের বেশি মানুষের জীবিকা এর ওপর নির্ভরশীল। এই দ্রুত বিকাশমান খাতটি যখন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার মুখাপেক্ষী, ঠিক তখনই এর প্রধান অভিভাবক সংস্থা ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্বহীনতার গভীর সংকটে নিমজ্জিত।

ই-ক্যাব’র কার্যনির্বাহী পরিষদ (ইসি)-এর নির্ধারিত নির্বাচন গত বছর ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই না হওয়া, ৫ আগস্টের পরবর্তীতে বিগত কার্যনির্বাহী পরিষদের পদত্যাগ এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০২৪-২৫ সাল জুড়েই নতুন নির্বাচন বারবার স্থগিত হওয়ায় কার্যক্রমে নেমে এসেছে সীমাহীন স্থবিরতা। এই অচলাবস্থা শুধু একটি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা (গণঅভ্যুত্থান, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট) পরবর্তী সময়ে নীতিগত সহায়তা প্রাপ্তি, বাজার স্থিতিশীলতা এবং উদ্যোক্তাদের আস্থায় চিড় ধরার মতো বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পুরো ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি শক্তিশালী ও নির্বাচিত নেতৃত্ব ছাড়া এই খাত কীভাবে এগিয়ে যাবে, সেই প্রশ্নই এখন মুখ্য।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: নেতৃত্বহীনতার বহুমুখী প্রভাব
ই-ক্যাবের এই নেতৃত্বশূন্যতা সদস্য, সরকার এবং সমগ্র ই-কমার্স খাতের ওপর এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ই-কমার্স খাতের জরুরি নীতি ও আইন প্রণয়নে সরকারের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা ই-ক্যাবের জোরালো ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত । ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা, ডেটা সুরক্ষা আইন ও সরকারি প্রণোদনা নিয়ে কার্যকর আলোচনা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে, খাতটির প্রয়োজনীয় সুরক্ষা এবং বিকাশে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

ই-ক্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অনেকেই মনে করছেন, ই-ক্যাব তাদের প্রত্যাশা পূরণে এবং স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দিকনির্দেশনাহীনতায় ভুগছে। ই-ক্যাবের বাইরেও লক্ষাধিক ই-কমার্স উদ্যোক্তা আছেন। তারা নীতিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ই-ক্যাবের মতো সংগঠনের সাহায্য প্রত্যাশা করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের এই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না, যা ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ: আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন ও এক বছরের বিরূপ প্রভাব (২০২৪-২৫)
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, কারফিউ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স খাতে বহুমুখী প্রভাব পড়েছে। ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্ল্যাকআউটের ১৩ দিনে ই-কমার্স খাতে আনুমানিক ১,৭৫০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। এই সময়ে ই-কমার্স খাতে প্রতিদিন ১২০ কোটি টাকারও অধিক ক্ষতি হয়েছে। এফ-কমার্স (ফেসবুক উদ্যোক্তা) খাতে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকারও বেশি, ই-কমার্স খাতে ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি, ই-লজিস্টিকস খাতে অন্তত ১০০ কোটি টাকা এবং ই-ট্যুরিজম খাতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ফেসবুক নির্ভর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হন, পুঁজি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কর্মী ছাঁটাই হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নেতৃত্বহীনতার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব (এক বছর ধরে)
ই-ক্যাবের নেতৃত্বশূন্যতার কারণে খাতের দাবিগুলো সরকারের কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা যায়নি। এই সময়ের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ই-ক্যাব থেকে কার্যকর পরামর্শ দেয়া হয়নি। স্বাভাবিক ২৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী খাতটি প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং স্থানীয় উদ্যোক্তা সহায়তার অভাবে তীব্রভাবে ব্যাহত হয়েছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনের দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে এই সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে যুক্ত হওয়ার সুযোগ সীমিত হয়েছে। ২০২৪-২০২৫ সময়কালে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ইকোসিস্টেমের সম্প্রসারণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে জটিলতা: কেন পিছিয়ে যাচ্ছে ই-ক্যাব?
ই-ক্যাবের নির্বাচন বারবার স্থগিত হওয়ার পেছনে রয়েছে কিছু গুরুতর সমস্যা-
ভোটার তালিকা বিতর্ক: নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ভোটার তালিকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। বৈধ সদস্য বাদ পড়া এবং ভুয়া ভোটারের নাম অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনি জটিলতা: ই-ক্যাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং আইনি চ্যালেঞ্জের কারণে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ আসায় নির্বাচন প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতা: আইনি জটিলতা এবং বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডাম বা সংঘ বিধির আধুনিকীকরণ না হওয়া নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: প্রশাসকের অধীনে সংগঠন
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ই-ক্যাব মূলত একটি নিথর নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত বছর জুলাই-আগস্টের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাঁর মেয়াদের শেষ হওয়ার পরে নতুন একজন প্রশাসক আবার নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁরা ই-ক্যাবকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও, নানা বাধা-বিপত্তির কারণে সদস্যদের সহায়ক হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন বিগত সময়গুলিতে কার্যকরভাবে চলেনি।

ই-ক্যাব-এর বর্তমান সংকটে জরুরি পদক্ষেপ (২০২৪-২৫ প্রেক্ষাপট)
ই-ক্যাব দেশের ই-কমার্স খাতের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন। এর উদ্দেশ্য হলো সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা এবং নতুন নীতিমালা তৈরীতে সরকারকে পরামর্শ দেয়া। এ ছাড়াও এটি সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণ ও দক্ষ জনবল তৈরিতে কাজ করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, গত একবছরের বেশি সময় ধরে ই-ক্যাব প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকায় ই-কমার্স খাতের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে না এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ই-ক্যাব থেকে কার্যকর কোনও পরামর্শ সরকারকে দেয়া হয়নি। সদস্যবৃন্দের চাহিদা অনুযায়ী অতিদ্রুত ই-ক্যাব-এর ফরেনসিক ফাইন্যানশিয়াল অডিট, মেম্বারশিপ অডিট ও মেমোর‍্যান্ডাম অব আর্টিকেলস্‌-এর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা জরুরী।

করণীয়: সদস্যদের ভূমিকা ও আশু পদক্ষেপ
বর্তমানে প্রশাসকের অধীনে সংগঠন চললেও, সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। সদস্যরা তাদের সমস্যা ও প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করে প্রশাসকের কাছে এই খাতের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে পারে। বিভিন্ন সদস্য প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত ফোরাম গঠন করে তা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে পারে, এতে দাবিগুলো আরও শক্তিশালী হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে এবং দ্রুত বৈধ ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য সদস্যরা প্রশাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে, বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী সংঘ বিধির আধুনিকীকরণেও তারা ভূমিকা রাখতে পারে।

ই-ক্যাবের ভবিষ্যৎ ও গঠনমূলক সংস্কার: কোন দিকে যাবে ই-কমার্স খাত
ই-ক্যাবের নেতৃত্ব সংকট পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তবে উত্তরণের পথ আছে। ই-ক্যাবের কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের কোনও বিকল্প নেই। বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা ২০২৫ অনুযায়ী সংঘ বিধির আধুনিকীকরণ করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা হলে নতুন নেতৃত্ব এই সংগঠনকে গতিশীল করতে পারবে।

নতুন কমিটির উচিত হবে সংগঠনের পুরোনো কাঠামোতে সংস্কার আনা। ভোটার তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে সদস্যপদ প্রদান, সবকিছুতেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে একটি আধুনিক অভিযোগ নিষ্পত্তির প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। ই-ক্যাবকে কেবল বড় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন না হয়ে, লাখ লাখ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে যেমন পেপ্যাল বা সমতুল্য প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে আনার জন্য সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাতে হবে।

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ও ভবিষ্যতের রূপরেখা
ই-ক্যাবের এই দীর্ঘ নেতৃত্ব সংকট ২০২৪-২০২৫ সময়কালে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি নীতিগত সমর্থন ও উদ্যোক্তা সহায়তার অভাব এই খাতকে পিছিয়ে দিয়েছে। তবে, ই-কমার্স খাতের নিজস্ব অন্তর্নিহিত শক্তি, লক্ষাধিক উদ্যোক্তার কর্মস্পৃহা এবং নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নীতিগত সংস্কারের সুযোগ, সবকিছুই প্রমাণ করে যে, সংকট থেকে উত্তরণের পথ এখনও উন্মুক্ত।

এই পরিস্থিতিতে, ই-ক্যাবের সদস্যবৃন্দ, প্রশাসক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিত হবে কালক্ষেপণ না করে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী, সংস্কারপন্থী এবং উদ্যোক্তাবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। শুধুমাত্র একটি সক্রিয় ও জবাবদিহি মূলক ই-ক্যাবই পারে সরকারের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় সাধন করে, ক্রেতা ও বিক্রেতার আস্থা ফিরিয়ে এনে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে এবং এর বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *