দেশের প্রথম নিজস্ব জাতীয় কার্ড স্কিম ‘টাকা পে’
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ: দেশের প্রথম নিজস্ব জাতীয় কার্ড স্কিম ‘টাকা পে’ চালু করা হয়েছে। ‘টাকা পে’ কার্ডের ধরন হবে ভিসা ও মাস্টারকার্ডের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত ইলেকট্রনিক পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ‘ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ’ ব্যবহার করে জাতীয়ভাবে একই সেবা দেবে ‘টাকা পে’ কার্ড। ফ্রান্সের পরামর্শ প্রতিষ্ঠান ‘ফাইম’ কার্ডটি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সরকার যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর ভিশন হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হলো ক্যাশলেস সোসাইটি। সেই ক্যাশলেস সোসাইটির পথে সরকারের একটি বড় পদক্ষেপ হলো ‘টাকা পে’ কার্ড।
প্রাথমিকভাবে দেশে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য এটি চালু করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এর মাধ্যমে টাকা-রুপি কার্ডও চালু করা হবে, যার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ ভারতে লেনদেন করা যাবে। নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি পুরনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও এই কার্ডের মাধ্যমে সেবা নেয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টের বিপরীতে আগের নেয়া ডেবিট কার্ডটি স্থগিত করে ‘টাকা পে’ কার্ডের সেবা নেয়া যাবে।
প্রথমে আটটি ব্যাংক পাইলট ভিত্তিতে এই কার্ড ইস্যু করবে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ব্যাংকও ইস্যু করতে পারবে। ব্যাংকগুলো হলো ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক এরই মধ্যে টাকা পে কার্ড সেবা চালু করেছে। ব্যাংক বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিসা ও মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে যেসব সেবা পাচ্ছে, একই সেবা ‘টাকা পে’ কার্ড দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘‘চিকিৎসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে অনেকে ভারতে যান। এ জন্য মার্কিন ডলার কিনে ভারতে গিয়ে রুপিতে রূপান্তর করতে হয়। এতে ভ্রমণকারীকে প্রায়ই বিনিময় হারে লোকসানে পড়তে হয়। এ অবস্থা উত্তরণে ‘টাকা পে’ নামের ডেবিট কার্ড আনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে মানুষ টাকা বা রুপি উত্তোলন করতে পারবেন। এটি ভারতে ভ্রমণকারী বাংলাদেশিরা অর্থ প্রদানের জন্য ব্যবহার করতে পারবেন। এর মাধ্যমে দেশের বিদেশি কার্ডের ওপর নির্ভরতা কমার পাশাপাশি ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। জাতীয় ডেবিট কার্ড ভিসা ও মাস্টারকার্ডের মতো আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমগুলোর ওপর থেকে নির্ভরতা কমাবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। ‘টাকা পে’ কার্ড প্রাথমিকভাবে অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা হবে।’’
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ‘‘ভিসা, মাস্টারকার্ড ও অ্যামেক্সের মতো আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম আছে এবং তাদের কার্ড সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য। লেনদেন মধ্যস্থতা করার নিজস্ব ব্যবস্থাও তাদের আছে। তবে ‘টাকা পে’ কার্ডের লেনদেন নিষ্পত্তি হবে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ অব বাংলাদেশ (এনপিএসবি)–এর মাধ্যমে। এখন এক ব্যাংকের গ্রাহক অন্য ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তুলতে গেলে এই এনপিএসবি সুবিধা ব্যবহার করেন। আপাতত দেশের মধ্যে এই সেবা চালু হবে। ভবিষ্যতে টাকা পে কার্ড ভারতেও ব্যবহার করা যাবে বলে জানিয়েছেন।’’
‘টাকা পে’ কার্ড কিভাবে কাজ করবে
শুরু থেকেই দেশের সব এটিএম, পয়েন্টস অব সেলস ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এই কার্ড ব্যবহার করা যাবে। শুরুতে এটি ডেবিট কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা গেলেও ভবিষ্যতে ‘টাকা পে’ ক্রেডিট কার্ডও আসবে। এই কার্ডের নিরাপত্তায় ব্যবহার করা হচ্ছে ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ। তবে এখন সব ব্যাংকের কার্ডেই বাড়তি নিরাপত্তা সংবলিত নতুন ইএমভি প্রযুক্তি চালু হয়েছে। ‘টাকা পে’ কার্ডও ইএমভি প্রযুক্তি আনা হবে।
‘টাকা পে’ কার্ড
এটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত একটি ডেবিট কার্ড। এটি ভিসা ও মাস্টারকার্ডের মতোই একটি ডেবিট কার্ড। ‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ ব্যবহার করে কেনাকাটা, টাকা উত্তোলন এবং অন্যান্য লেনদেন করতে পারবেন।
মালিকানা কার
‘টাকা পে’ কার্ডের মালিকানা বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি) এর মাধ্যমে ‘টাকা পে’ কার্ড পরিচালনা করে। এনপিএসবি হলো বাংলাদেশের একটি কেন্দ্রীয় পেমেন্ট সুইচ।
সুবিধা
‘টাকা পে’ কার্ড ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা একটি সুরক্ষিত ও নিরাপদ পেমেন্ট নেটওয়ার্ক। এই কার্ড ব্যবহার করা সহজ ও সুবিধাজনক। এই কার্ডের লেনদেন ফি অন্যান্য আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমের তুলনায় কম। এই কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা বাংলাদেশে এবং বিদেশে কেনাকাটা করতে পারবেন। এ ছাড়াও, ‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটা, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট, মোবাইল রিচার্জ ইত্যাদি করতে পারবেন। এর মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের তুলনামূলক কম ফি দিতে হয়। এই কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করা তুলনামূলক বেশি নিরাপদ। ‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারেন।
কোন কোন ব্যাংক ‘টাকা পে’ কার্ড চালু করেছে
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশের তিনটি ব্যাংক প্রথমবারের মতো জাতীয় ডেবিট কার্ড ‘টাকা পে’ কার্ড চালু করে। এই ব্যাংকগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক। পরবর্তীতে, অন্যান্য ব্যাংকও ‘টাকা পে’ কার্ড চালু করার পরিকল্পনা করছে। টাকা পে কার্ড চালু করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও স্বাধীন এবং নিরাপদে করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
‘টাকা পে’ কার্ডের অন্তর্ভূক্ত ব্যাংক
২০২৩ সালের ১ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘টাকা পে’ কার্ডের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে, আটটি ব্যাংক ‘টাকা পে’ কার্ড ইস্যু করছে। এগুলো হলো: ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ভবিষ্যতে, আরও বেশি ব্যাংক ‘টাকা পে’ কার্ড ইস্যু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
‘টাকা পে’ কার্ড চার্জ, ইস্যু ফি এবং বাৎসরিক ফি
‘টাকা পে’ কার্ডের চার্জ, ইস্যু ফি এবং বাৎসরিক ফি নির্ভর করে ব্যাংকের ওপর। তবে সাধারণত, ‘টাকা পে’ কার্ডের ইস্যু ফি এবং বাৎসরিক ফি অন্যান্য আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমের তুলনায় কম। টাকা পে কার্ডের ইস্যু ফি ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। টাকা পে কার্ডের বাৎসরিক ফি ২০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
লেনদেন ফি
টাকা পে কার্ডের লেনদেন ফিও ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে। তবে সাধারণত, টাকা পে কার্ডের লেনদেন ফি অন্যান্য আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমের তুলনায় কম।
উদাহরণস্বরূপ, ব্র্যাক ব্যাংকের টাকা পে কার্ডের ইস্যু ফি ৩০০ টাকা এবং বাৎসরিক ফি ৫০০ টাকা। টাকা পে কার্ডের মাধ্যমে দেশে কেনাকাটা করলে কোনও লেনদেন ফি দিতে হবে না। তবে বিদেশে কেনাকাটা করলে প্রতি লেনদেনে ০.৫% লেনদেন ফি দিতে হবে। টাকা পে কার্ডের চার্জ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নির্দিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
‘টাকা পে’ কার্ড কিভাবে পাওয়া যায়
‘টাকা পে’ কার্ড পেতে হলে আপনাকে যেকোনো ‘টাকা পে’ কার্ড অন্তর্ভূক্ত ব্যাংকে একটি ডেবিট অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। অ্যাকাউন্ট খোলার পর, আপনি ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার থেকে ‘টাকা পে’ কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন। আবেদন করার সময়, আপনাকে যে সকল কাগজপত্র জমা দিতে হবে- পাসপোর্ট সাইজের ছবি (২ কপি); জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি; আয়ের প্রমাণপত্রের ফটোকপি।
‘টাকা পে’ কার্ডের জন্য আবেদন করার পর, ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার আপনার আবেদনটি যাচাই করবে এবং আপনার আবেদন অনুমোদিত হলে আপনাকে টাকা পে কার্ডটি সরবরাহ করবে। টাকা পে কার্ডের জন্য আবেদন করার সময়, ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার থেকে টাকা পে কার্ডের সুবিধা এবং চার্জ সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।
‘টাকা পে’ কার্ড ব্যবহার করা যাবে
‘টাকা পে’ কার্ডের কার্যপ্রণালী অন্যান্য ডেবিট কার্ডের মতোই। ‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করার জন্য, গ্রাহককে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে কার্ডটি লিঙ্ক করতে হবে। এরপর, গ্রাহক যেকোনো দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে ‘টাকা পে’ কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করতে পারবেন।
লেনদেনের সময়, দোকান বা প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি গ্রাহকের কাছ থেকে কার্ডটি গ্রহণ করবেন এবং কার্ডের পিন নম্বর চাইবেন। গ্রাহক তার কার্ডের পিন নম্বর প্রদান করলে, লেনদেন সম্পন্ন হবে। ‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করার সময়, গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেনের পরিমাণ কর্তন করা হবে। লেনদেন সম্পন্ন হলে, গ্রাহক তার কেনাকাটার পণ্য বা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করার জন্য, গ্রাহককে অবশ্যই পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করতে হবে- একটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলুন। আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ‘টাকা পে’ কার্ড লিঙ্ক করুন। আপনার কার্ডের পিন নম্বর জেনে নিন। যেকোনো দোকানে বা প্রতিষ্ঠানে ‘টাকা পে’ কার্ড ব্যবহার করুন।
‘টাকা পে’ কার্ড লেনদেন করার ক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি
আপনার কার্ডের পিন নম্বর অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না। আপনার কার্ডটি হারিয়ে গেলে বা চুরি গেলে, তাৎক্ষণিকভাবে আপনার ব্যাংককে জানান। আপনার কার্ডটি ব্যবহার করার সময়, এটিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবেন না। ‘টাকা পে’ কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করা নিরাপদ। তবে, কিছু বিষয়ের প্রতি সচেতন থাকলে আপনি আরও বেশি নিরাপদ থাকতে পারেন।