ঢাকার বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডে রোবট ও ড্রোনের বীরত্ব

ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ (তুষার): ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি যেমন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তেমনি এটি দেখিয়েছে বাংলাদেশের জরুরি সেবা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির নতুন এক দিগন্ত। রোবট ও ড্রোনের যৌথ ব্যবহারে এই অগ্নিনির্বাপণ অভিযান শুধু সময় বাঁচায়নি, বরং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে আগুনের ভয়াবহতা। এবারই প্রথম এত বড় পরিসরে রোবট ও ড্রোন ব্যবহারে সফল হয় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
ঘটনার শুরু ও চ্যালেঞ্জ
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে হঠাৎ করেই ধোঁয়া ও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দাহ্য পদার্থ, ইলেকট্রিক তার ও ভেতরের জটিল কাঠামোর কারণে দমকলকর্মীদের পক্ষে শুরুতে আগুনের উৎসে পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত কঠিন। এমন সময়েই প্রযুক্তিনির্ভর অগ্নিনির্বাপণ ইউনিটের সদস্যরা নামেন মাঠে।
রোবটের সাহসী ভূমিকা
এই অভিযানে ব্যবহৃত হয় বিশেষ ফায়ার রেসকিউ রোবট। জার্মান ও স্থানীয় প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি এই রোবট আগুনের তীব্র তাপেও কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি দূরনিয়ন্ত্রিতভাবে আগুনের কেন্দ্রে প্রবেশ করে, সেন্সরের মাধ্যমে তাপমাত্রা শনাক্ত করে এবং পানি বা ফোম স্প্রে করে আগুন নেভাতে সাহায্য করে। মানুষ যেখানে প্রবেশ করতে পারে না, সেখানে রোবট কাজ করেছে। এই রোবটগুলোতে থার্মাল ক্যামেরা ও ইনফ্রারেড সেন্সর থাকায় আগুনের উৎস চিহ্নিত করা সহজ হয়। এতে উদ্ধারকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসে। শুধু অগ্নিনির্বাপণ নয়, রোবটগুলো ধোঁয়ায় ঢাকা এলাকা থেকে পথ নির্দেশনা দিতেও সাহায্য করেছে।
ড্রোনের নজরদারি ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ
আকাশপথে সক্রিয় ছিল একাধিক ড্রোন। এগুলো লাইভ ভিডিও ফিডের মাধ্যমে আগুনের বিস্তার, ছাদ ও বায়ু চলাচলের পথের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। এতে অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়-কোথায় পানি ছোড়া হবে, কোন দিক থেকে প্রবেশ নিরাপদ, কোথায় উদ্ধার দল পাঠাতে হবে ইত্যাদি। ড্রোনের হাই-রেজ্যুলেশন ক্যামেরা ও থার্মাল ইমেজিং প্রযুক্তি অগ্নিকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু শনাক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফলে একদিকে সময় কম লেগেছে, অন্যদিকে পানি ও ফোমের অপচয়ও রোধ করা গেছে।
রোবট ও ড্রোনে অগ্নিনির্বাপণের সুবিধা
দূরনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করা যায়। উদ্ধারকর্মীদের জীবন ঝুঁকি কমে। দ্রুত উৎস শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ। পানি ও ফোমের অপচয় কম। ২৪ ঘণ্টা নজরদারির সক্ষমতা।
মানবিক সুরক্ষা ও কার্যকারিতা
অগ্নিনির্বাপণের সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকে উদ্ধারকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রোবট ও ড্রোন ব্যবহারের ফলে এবার দমকলকর্মীরা নিরাপদ দূরত্বে থেকেই পুরো অপারেশন পরিচালনা করতে পেরেছেন।
বাংলাদেশে স্মার্ট ফায়ার ম্যানেজমেন্টের সূচনা
বাংলাদেশে আগুন নেভাতে রোবট ও ড্রোন ব্যবহারের এই উদ্যোগ নতুন নয়, তবে বিমানবন্দরের মতো উচ্চ নিরাপত্তাসংবলিত এলাকায় এটি প্রথমবারের মতো এত সফলভাবে প্রয়োগ হলো। ভবিষ্যতে বন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শপিং মল ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া দেশে ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে কিছু স্বল্প খরচের রোবট, যেগুলো ভবিষ্যতে গ্রামীণ ও ছোট শহরের ফায়ার স্টেশনে যুক্ত করা যেতে পারে।
এ ধরনের স্মার্ট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা শুধু আধুনিকতার প্রতীক নয়, বরং মানবসম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষার কার্যকর মাধ্যম। রোবট-ড্রোনভিত্তিক ফায়ার সিস্টেম আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এর জন্য দরকার নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডের এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে প্রযুক্তিনির্ভর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। সরকারের ডিজিটাল রুপান্তর পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রমে রোবট, ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং সেন্সরভিত্তিক সতর্কতা ব্যবস্থা যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা গেলে ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক পর্যায়েই সতর্কবার্তা পাওয়া যাবে, আগুন ছড়ানোর আগেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বা ফোম ছোড়া শুরু হবে- যা শতাধিক প্রাণ ও কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হবে। ঢাকার বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে রোবট ও ড্রোনের সফল ব্যবহারে প্রমাণ মিলেছে- প্রযুক্তি কেবল বিলাসিতা নয়, এটি এখন জীবনরক্ষার অস্ত্র।
অগ্নিনির্বাপণে এই প্রযুক্তির বিস্তারই হতে পারে নিরাপদ বাংলাদেশের পরবর্তী ধাপ। বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ডে রোবট ও ড্রোনের সাহসী ভূমিকা দেখিয়েছে, আগামীর অগ্নিনির্বাপণ হবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর। জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এই উদ্ভাবনী উদ্যোগই হতে পারে নিরাপদ বাংলাদেশের পথচলার পরবর্তী অধ্যায়।