প্রতিবেদন

ডিজিটাল থেকে কুটির শিল্প, সবখানে নারী: নীরব বিপ্লবের চিত্র

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যে নীরব বিপ্লব ঘটে চলেছে, তার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলেন নারী উদ্যোক্তারা। একসময় ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকা নারীরা আজ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন। দেশের হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পোশাক শিল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত- সব ক্ষেত্রেই তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে এই অগ্রযাত্রার পথ মসৃণ নয়। একজন নারী উদ্যোক্তাকে পুরুষ উদ্যোক্তার তুলনায় অনেক বেশি বাধা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়।

প্রতিবন্ধকতার পাহাড়: কেন একজন নারী উদ্যোক্তার পথ এত কঠিন
একজন নারী যখন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তখন তাকে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
১. পুঁজি এবং আর্থিক সমর্থন: নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো পুঁজি। নারীদের জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়া এখনও বেশ কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পেতে পুরুষদের চেয়ে বেশি কাঠখড় পোড়ান। জামানত বা গ্যারান্টির অভাবে প্রায়শই তারা আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন।

২. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা: আমাদের সমাজে এখনও অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে কেবল গৃহস্থালি কাজের জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়। একজন নারী যখন ব্যবসা শুরু করেন, তখন তাকে প্রায়শই পরিবার বা সমাজের পক্ষ থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশের বেশি নারী উদ্যোক্তা তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে পারিবারিক বা সামাজিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হন।

এই প্রসঙ্গে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা বলেন, যখন আমি ব্যবসা শুরু করার কথা বলেছিলাম, আমার পরিবারের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। আমাকে বলা হয়েছিল, মেয়েদের এসবের দরকার নেই, সংসার সামলাও। কিন্তু আমার নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল এবং সেই বিশ্বাসই আমাকে এগিয়ে নিয়েছে।

৩. নেটওয়ার্কিং ও বাজারের সীমাবদ্ধতা: ব্যবসার প্রসারের জন্য নেটওয়ার্কিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষ-প্রধান ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কগুলোতে একজন নারী উদ্যোক্তার প্রবেশ প্রায়শই কঠিন হয়। এর ফলে তারা নতুন গ্রাহক, সরবরাহকারী এবং ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজে পেতে হিমশিম খান।

আশার আলো: সুযোগ এবং সহায়তার হাত
এতসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে, যেখানে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক নারীদের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ এবং পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প চালু করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য মোট বিতরণকৃত ঋণের একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো (MFI) যেমন গ্রামীণ ব্যাংক প্রান্তিক পর্যায়ের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

নীতিমালার কার্যকারিতা ও সমাজের বাস্তবতা
সরকারি নীতিমালাগুলো কাগজে-কলমে যতটা সহায়ক, বাস্তবে তার প্রয়োগ সবক্ষেত্রে ততটা সহজ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪ শতাংশ সুদের ঋণের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, অনেক নারী উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ঋণ পেতে ব্যর্থ হন। তবে যারা এই সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের একটি বড় অংশ সফলভাবে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন।

এ ছাড়াও, দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের এক বিশাল অংশ অবদান রাখছে। ঘরে বসে পিঠা, আচার, হস্তশিল্প বা তৈরি পোশাকের ব্যবসা করা এই নারীরা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক হিসাবের আওতাভুক্ত নন। তাদের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আকার বিশাল হলেও, তারা সরকারি সহায়তা ও ঋণের বাইরে থেকে যান। এই ক্ষেত্রে, ব্র্যাক -এর মতো এনজিওগুলো ক্ষুদ্রঋণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ের নারীদের স্বাবলম্বী করতে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে।

নীতি নির্ধারণ ও ব্যবসায়িক সংগঠনে নারীর ভূমিকা: নেতৃত্ব ও প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তারা শুধু নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করেই অবদান রাখছেন না, বরং তারা বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক সংগঠন ও নীতি নির্ধারণী ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এর মাধ্যমে তারা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য সরাসরি কাজ করতে পারছেন।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর মতো শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন পোশাক শিল্পে রুবানা হক, যিনি বিজিএমইএ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মতো নেতৃত্ব স্থানীয়রা নীতিগত পর্যায়ে নারীদের পক্ষে কথা বলতে পারেন, যা ঋণের শর্ত সহজীকরণ এবং বাজারের উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীর ভূমিকা: নতুন দিগন্তের উন্মোচন
বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাত এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। এই খাত নারীদের জন্য ভৌগোলিক এবং সামাজিক বাধা অতিক্রম করার এক অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। বর্তমানে নারীরা ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাবেচার পাশাপাশি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন এবং ফ্রিল্যান্সিং-এর মতো কাজেও নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করছেন। কোভিড-১৯ মহামারী নারী উদ্যোক্তাদের অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনায় উৎসাহিত করেছে, যা তাদের ব্যবসাকে আরও আধুনিক ও প্রযুক্তি-নির্ভর করে তুলেছে।

সফলতার আলোকবর্তিকা: কিছু দৃষ্টান্তমূলক কেস স্টাডি
বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের যাত্রাপথ শুধু চ্যালেঞ্জ বা সুযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা অদম্য সাহস ও কঠোর পরিশ্রমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে তাদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা কিছু সফলতার গল্প থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়-

পোশাক ও চামড়াশিল্প: বিবি রাসেল তার প্রতিষ্ঠান বিবি প্রোডাকশন-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাদি ও তাঁতশিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেছেন। শাহনাজ খান তার ব্র্যান্ড কে-ক্র্যাফট দিয়ে তিন দশক ধরে সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তানিয়া ওয়াহাব তার লেদার ব্র্যান্ড কান (KAAN) দিয়ে চামড়াজাত পণ্যের বাজারে একটি নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছেন।

লজিস্টিকস: সাদিয়া আফরিন স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে লজিস্টিকসের মতো পুরুষ-শাসিত শিল্পে তার নেতৃত্ব প্রমাণ করেছেন।

প্রযুক্তি: সোনিয়া বশির কবির তার প্রতিষ্ঠান এসবিকে টেক ভেঞ্চারস-এর মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও পরামর্শ দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর আগে তিনি মাইক্রোসফ্ট বাংলাদেশের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাসলিমা মিজি তার প্রতিষ্ঠান টেকম্যানিয়া-এর মাধ্যমে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসা করছেন। সাদিয়া হক শেয়ারট্রিপ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রযুক্তি-নির্ভর সেবা দিয়ে এই খাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।

স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা: ডা. শাহানা জামান তার ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম ‘সঞ্জীবনী’-এর মাধ্যমে টেলিমেডিসিন ও অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে, সাদিকা হাসান তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষালয়-এর মাধ্যমে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ তৈরি করেছেন।

বিউটি ও ওয়েলনেস: কানিস আলমাস খান তার পারসোনা-এর মাধ্যমে এই খাতকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং হাজার হাজার নারীকে প্রশিক্ষিত করে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।

খাদ্য ও কৃষি: মালিহা মাহবুব তার ব্র্যান্ড মাদল দিয়ে খাদ্য শিল্পে নতুন ধারা তৈরি করেছেন। বগুড়ার কৃষি উদ্যোক্তা মিজানুর নাহার বিউটি সফলভাবে জৈব চাষ, মাছ ও পোল্ট্রি খামার পরিচালনা করছেন। আয়েশা সিদ্দিকা শুটকি ব্যবসায় এবং তানিয়া ইসলাম তার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তানিয়াস কিচেন-এর মাধ্যমে তৈরি খাবারের ব্যবসায় সফলতা পেয়েছেন।

সামাজিক উদ্যোগ: জেসমিন আক্তার নীলা তার সন্দি বহুমুখী কর্মজীবী সমিতি-এর মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।

অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা এবং পরিসংখ্যানগত চিত্র
বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৬ শতাংশ নারী। এফবিসিসিআই-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের প্রায় ৭ শতাংশ সরাসরি নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত। এই খাতের বার্ষিক অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, দেশের মোট অনলাইন ব্যবসার প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত।

ভবিষ্যতের পথে: করণীয় এবং প্রত্যাশা
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সম্পূর্ণ সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে নীতিমালা সহজীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা শুধু নিজেদের ভাগ্যই পরিবর্তন করছেন না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের অদম্য সাহস এবং কঠোর পরিশ্রম বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধুমাত্র উদ্যোক্তা নন, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম প্রতীক।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *