গ্লোবাল র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান, উন্নতিতে বাধা সমূহ এবং সমাধান
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স ল্যান্ডস্কেপে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশীদার। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনগুলোর মধ্যে এর কোনও নির্দিষ্ট বিশ্বব্যাপী র্যাঙ্কিং নেই। ই-ক্যাব যদিও কনজিউমার টেকনোলজি অ্যাসোসিয়েশন (সিটিএ), ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন (এনআরএফ) এর মতো গ্লোবাল সংগঠনগুলোর সদস্য না এবং আলিবাবা গ্রুপ বা অ্যামাজনের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মত এটির বিশ্বব্যাপী প্রসার নেই।
তবে ই-ক্যাব বাংলাদেশের একমাত্র ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য একটি শীর্ষস্থানীয় অ্যাসোসিয়েশন হিসাবে স্বীকৃত এবং দেশের ই-কমার্স ইকোসিস্টেম গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল অর্থনীতির বৃদ্ধি ও উন্নয়নে ই-ক্যাব অবদান রাখছে ২০১৪ প্রতিষ্ঠা কাল থেকেই।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি সংস্থা এবং প্ল্যাটফর্ম বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের র্যাঙ্কিং এবং তার ইনসাইটগুলো নিয়ে কাজ করে। এখানে তেমন কয়েকটির নাম উল্লেখ করা হলো-
ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCTAD)
সংস্থাটি বিজনেস-টু-কনজিউমার (বি২সি) বার্ষিক ই-কমার্স সূচক প্রকাশ করে। অনলাইন ব্যবসাকে সমর্থন এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশগুলোর প্রস্তুতির মূল্যায়ন করে।
ডিজিটাল কমার্স ৩৬০ (Digital Commerce 360)
উত্তর আমেরিকার শীর্ষ এক হাজার অনলাইন খুচরা বিক্রেতাদের সহ বিভিন্ন র্যাঙ্কিং প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের অগ্রগতির প্রবণতা এবং তার কর্মক্ষমতা সম্পর্কে আলোকপাত প্রদান করে।
সিমিলার ওয়েব (SimilarWeb)
ট্রাফিক এবং এনগেজমেন্ট এর ওপর ভিত্তি করে ই-কমার্স ওয়েব সাইটগুলোকে মূল্যায়ন করে বা স্থান দেয়। ওয়েব সাইটের কর্মক্ষমতা এবং বাজারের অংশীদারিত্ব সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ প্রদান করে।
স্টাটিসটা (Statista)
ই-কমার্স সহ বিভিন্ন শিল্পের ওপর তথ্য এবং বিশ্লেষণ প্রদান করে। বাজারের আকার, বৃদ্ধির হার এবং ভোক্তাদের আচরণ সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রদান করে।
ই-কমার্সডিবি (E-commerceDB)
বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের বিক্রয় এবং বাজারের প্রবণতা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে। বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলের ই কমার্সের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রদান করে।
এই র্যাঙ্কিং প্রায়শই বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং বাজারের আকার, বৃদ্ধির হার, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং ভোক্তাদের আচরণের মতো বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে। অতএব, একাধিক উৎসের মাধ্যমে তথ্য যাচাই এবং প্রতিটি র্যাঙ্কিংয়ের জন্য ব্যবহৃত নির্দিষ্ট মানদণ্ড অপরিহার্যভাবে বিবেচনা করে। তবে দুর্ভাগ্যবশত,স্টাটিসটা এবং ডিজিটাল কমার্স ৩৬০ পৃথক দেশের ই-কমার্স সেক্টরের জন্য নির্দিষ্ট বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং প্রদান করে না। তারা প্রায়শই বিস্তৃত অবস্থান, বাজারের আকার এবং প্রধান ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বা অংশীদারদের দিকে বেশি ফোকাস করে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় যা এর বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বাধা দেয়
পরিকাঠামোর অভাব-
ইন্টারনেট সংযোগ: ইন্টারনেটের এই যুগে, বিশেষ করে উচ্চগতির ইন্টারনেট, সারা দেশে এক সমান তো নেই অনেক জায়গায় তো একদমই নেই। এটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে গ্রাহকদের প্রবেশাধিকারকে সীমাবদ্ধ করে এবং বিরামবিহীন ই-কমার্স অভিজ্ঞতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
লজিস্টিক এবং ডেলিভারি: দেশের লজিস্টিক কাঠামো, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল অনুন্নত যার ফলে বিলম্বিত এবং আস্থা হীনতার মধ্যে ডেলিভারি হয়, যা গ্রাহকের সন্তুষ্টিকে প্রভাবিত করে এবং অনলাইন কেনাকাটা নিরুৎসাহিত করে।
পেমেন্ট সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা-ক্যাশ-অন-ডেলিভারি আধিপত্য: ক্যাশ-অন-ডেলিভারি প্রাথমিক পেমেন্ট পদ্ধতি হিসাবে রয়ে গেছে, যা ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অনলাইন লেনদেনের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।
সীমিত অর্থপ্রদানের বিকল্প: নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ অনলাইন অর্থপ্রদানের বিকল্পগুলোর প্রাপ্যতা সীমিত, যা অনলাইন কেনাকাটার প্রতি ভোক্তাদের আস্থা হ্রাস করে।
নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবেশ-
পরিষ্কার নিয়মকানুনের অভাব: ই-কমার্সের জন্য একটি স্পষ্ট এবং সহায়ক নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো এখনও তৈরি হয়নি, যা ব্যবসা এবং ভোক্তাদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
কর এবং শুল্ক সংক্রান্ত সমস্যা: জটিল কর এবং শুল্ক পদ্ধতি খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং সরবরাহ বিলম্বিত করতে পারে, যা সামগ্রিক ই-কমার্স অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে।
বিশ্বাস এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ-
ভোক্তাদের বিশ্বাস: অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে আস্থা তৈরি করা এবং নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে জালিয়াতি এবং কেলেঙ্কারির অতীতের ঘটনার কারণে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে।
তথ্যের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা: তথ্যের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ ভোক্তাদের অনলাইনে ব্যক্তিগত তথ্য ভাগ করে নেয়া থেকে বিরত করে।
প্রতিযোগিতামূলক ল্যান্ডস্কেপ-
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজার আমাজন ও আলিবাবার মতো বৈশ্বিক জায়ান্টদের কাছ থেকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি, যাদের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ, সম্পদ ও দক্ষতা রয়েছে।
স্থানীয় বাজারের ডায়নামিক্স: স্থানীয় বাজারটি বিভক্ত, অসংখ্য ছোট এবং মাঝারি আকারের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের অংশীদারিত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও এর বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে উন্নত করতে এবং এর পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মুক্ত করতে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা অপরিহার্য। পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ, ডিজিটাল পেমেন্টের প্রচার, নিয়মকানুনকে সুবিন্যস্ত করা এবং আস্থা ও নিরাপত্তা জোরদার করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের ক্ষেত্রে নিজেকে একটি প্রধান অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
ই-ক্যাব বাংলাদেশে ই-কমার্সে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও, এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে সমস্যা বা ত্রুটি রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য পদক্ষেপ বা সমাধান করতে পারলে হয়তো বাংলাদেশ সহ গ্লোবালি ই-কমার্স আরও বহুদূর এগিয়ে যেত।
স্থানীয় সমস্যা-
কঠোর প্রয়োগের অভাব: ই-ক্যাবের নির্দেশিকা ও নিয়মকানুন থাকলেও প্রয়োগ অনেক সময় অসঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে। এটি কিছু ই-কমার্স ব্যবসার দ্বারা অনৈতিক অনুশীলনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা ভোক্তাদের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সমাধান: লঙ্ঘনের জন্য কঠোর প্রয়োগকারী ব্যবস্থা এবং জরিমানা প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করুন।
সীমিত ভোক্তা সুরক্ষা: যদিও ই-ক্যাব ভোক্তা অধিকারের পক্ষে কথা বলে, ভোক্তা সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত বাস্তবায়ন ধীর এবং অকার্যকর হতে পারে।
সমাধান: জালিয়াতি ও অপব্যবহার রোধে শক্তিশালী ভোক্তা সুরক্ষা নীতি তৈরি করা এবং সক্রিয়ভাবে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো পর্যবেক্ষণ করা।
অকার্যকর বিরোধ নিষ্পত্তি: ই-ক্যাব দ্বারা প্রদত্ত বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং স্বচ্ছতার অভাব হতে পারে, যা ভোক্তা এবং ব্যবসা উভয়ের জন্যই হতাশার কারণ হতে পারে।
সমাধান: বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করা, সময়োপযোগী ও স্বচ্ছ সমাধান প্রদান করা এবং মধ্যস্থতা ও সালিশের মতো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া অন্বেষণ করা।
ডিজিটাল সাক্ষরতার ব্যবধান: যদিও ই-ক্যাব ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রচার করে, তবুও সাধারণ জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ডিজিটাল সাক্ষরতার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়েছে। এটি ই-কমার্স গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।
সমাধান: প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সচেতনতা প্রচারের মাধ্যমে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) ওপর সীমিত ফোকাস: ই-ক্যাব সামগ্রিক ই-কমার্স ইকোসিস্টেমকে সমর্থন করলেও, ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য এসএমইগুলোকে ক্ষমতায়নের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেয়া যেতে পারে।
পদক্ষেপ: এসএমইগুলোকে তাদের অনলাইন উপস্থিতি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য লক্ষ্যযুক্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, পরামর্শদাতা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
বৈশ্বিক সমস্যা
সীমিত আন্তর্জাতিক পরিচিতি: বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশী ই-কমার্স ব্যবসার প্রচারে ই-ক্যাব আরও বেশি কিছু করতে পারে, বিশেষ করে বিপণন ও ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে।
সমাধান: বাংলাদেশী পণ্য ও তাদের সেবা প্রদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, ওয়েবিনার এবং কর্মশালার আয়োজন করা।
শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের অভাব: যদিও ই-ক্যাবের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব রয়েছে, বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স জায়ান্ট এবং অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব নেই, যদি সেটা হত তাহলে বাংলাদেশী ই-কমার্স শিল্প উপকৃত হতে পারে।
সমাধান: বাজারে প্রবেশাধিকার ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুবিধার্থে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা।
আন্ত:সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য অপর্যাপ্ত সহায়তা: শুল্ক বিধি, লজিস্টিকস এবং অর্থপ্রদানের সমাধান সহ আন্ত:সীমান্ত বাণিজ্যের জটিলতাগুলো নেভিগেট করতে বাংলাদেশী ই-কমার্স ব্যবসায়ের জন্য আরও সমর্থন প্রয়োজন।
পদক্ষেপ: কাস্টমস রেগুলেশন, লজিস্টিক এবং পেমেন্ট সলিউশন সহ আন্ত:সীমান্ত বাণিজ্যের বিষয়ে ব্যাপক দিক নির্দেশনা প্রদান করা।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মাধ্যমে, ই-ক্যাব বাংলাদেশের ই-কমার্স শিল্পের বৃদ্ধি ও বিকাশে, স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী উভয় ক্ষেত্রেই অবদান রাখতে পারে। সামগ্রিকভাবে, ই-ক্যাব ই-কমার্স শিল্পের স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করে, ব্যবসায়ের ক্ষমতায়ন এবং ভোক্তাদের শিক্ষিত করে বাংলাদেশে ই-কমার্সের ভবিষ্যত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের প্রচেষ্টা ই-কমার্স ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রাখে, যা এটিকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য চালিকাশক্তি করে তোলে
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব।