প্রতিবেদন

গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর: ই-কমার্স ও আগামীর বাংলাদেশ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি তার গ্রামগুলোতে নিহিত। দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০.৬ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। এই গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হলো কৃষি, খামার ও দেশজ উৎপাদন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদকেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার অভাবে কৃষকের কঠোর শ্রম ও পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। ডিজিটাল রুপান্তরের এই সময়ে, ই-কমার্স এই পুরোনো চিত্রকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক মাধ্যম নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাওয়ার এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, খামারিদের উৎপাদিত দ্রব্য এবং দেশজ ঐতিহ্যবাহী পণ্য ই-কমার্সের মাধ্যমে সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তা গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করছে। এই প্রবন্ধে, আমরা তথ্য ও উপাত্তের আলোকে ই-কমার্স কীভাবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে, তা বিশ্লেষণ করব।

প্রচলিত বিপণন ব্যবস্থা: সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা
ঐতিহ্যবাহী বিপণন ব্যবস্থায় কৃষক বা উৎপাদক তার পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। সেখান থেকে একাধিক হাত ঘুরে তা শহরের বাজারে পৌঁছায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি স্তরে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। এতে একদিকে ভোক্তা অধিক মূল্য দিতে বাধ্য হন, অন্যদিকে উৎপাদক তার শ্রমের সঠিক মূল্য পান না। পচনশীল পণ্য যেমন তাজা ফল, শাক-সবজি বা মাছ প্রায়শই নষ্ট হয়, যা কৃষকদের বড় ক্ষতির মুখে ফেলে। একইভাবে, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী পণ্য যেমন নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, মৃৎশিল্প, হাতে বোনা জামদানি, বা তাঁতের শাড়ি- এসবের কারিগররা আধুনিক প্রচার ও বিপণন কৌশলের অভাবে সীমিত বাজারের ওপর নির্ভরশীল। সঠিক বাজার না পাওয়ায় তাদের আয় সীমিত থাকে এবং এই শিল্পগুলো বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা

ই-কমার্স: একটি বৈপ্লবিক সমাধান
ই-কমার্স এই চ্যালেঞ্জগুলোর একটি কার্যকর ও সরাসরি সমাধান নিয়ে এসেছে। এটি মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে। এর ফলে-
১. ন্যায্য মূল্য এবং স্বচ্ছতা: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে, যা তাদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে। ভোক্তা জানেন যে তিনি সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্যটি কিনছেন, ফলে পণ্যের গুণগত মান নিয়েও তাদের আস্থা বাড়ে।

২. পণ্যের অপচয় হ্রাস: ই-কমার্স মডেল, বিশেষ করে ‘খামার থেকে ভোক্তার পাতে’ ব্যবস্থা, পচনশীল পণ্যের অপচয় উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়। অর্ডার পাওয়ার পর তাজা পণ্য সংগ্রহ করে সরাসরি ডেলিভারি দেয়া হয়।

৩. বাজারের পরিধি বৃদ্ধি: ই-কমার্স গ্রামীণ উৎপাদকদের জন্য শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একজন প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও এখন তার হস্তশিল্প পণ্য বা দেশীয় খাবার সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারেন।

৪. বহুমুখী পণ্যের নতুন বাজার: ই-কমার্স গ্রামীণ অর্থনীতির বহুমুখী পণ্যকে শহরের ক্রেতাদের কাছে নিয়ে আসছে। যেমন-
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য: কৃষকের জমি থেকে উৎপাদিত ধান, চাল, ডাল গম, হলুদ, মরিচ, মসলা সহ অন্যান্য পণ্য শহরের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।
অন্যান্য কৃষিপণ্য: রাসায়নিকমুক্ত সবজি, মধুপুর থেকে সংগ্রহ করা খাঁটি মধু, রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম, দিনাজপুরের লিচু, বা সুন্দরবনের মধু।
খামারি পণ্য: টাঙ্গাইল, পাবনা বা বগুড়ার খামার থেকে সরাসরি দুধ, ডিম, এবং মাংস।
ঐতিহ্যবাহী ও হস্তশিল্প: সিলেট ও সুনামগঞ্জের শীতলপাটি, যশোরের নকশিকাঁথা, কুমিল্লার খাদি, বা রাজশাহীর সিল্ক।

গ্রামীণ পণ্যের অর্থনৈতিক উপাত্ত ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির আকার বিশাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান প্রায় ১২.১ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু শস্য উৎপাদন থেকেই আসে ৬.১ শতাংশ, এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত থেকে আসে প্রায় ৪ শতাংশ। গ্রামীণ কুটির শিল্প, তাঁতশিল্প এবং অন্যান্য দেশজ পণ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আর্থিক মূল্যও বিশাল, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

বর্তমানে, বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা (আনুমানিক ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই বাজারের একটি বড় অংশ এখন গ্রামীণ পণ্যের দখলে চলে আসছে। একটি গবেষণা অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে গ্রামীণ ই-কমার্সের বাজার প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি এই খাতকে সঠিকভাবে সহায়তা করা হয়, তাহলে আগামী ১০ বছরে এর বাজার আকার $১০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে। ই-কমার্স গ্রামীণ অর্থনীতিতে সরাসরি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে, যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করছে এবং গ্রামীণ মানুষের আয় বৃদ্ধি করছে। এর ফলে একদিকে যেমন দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে গ্রামীণ সমাজ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে।

বিনিয়োগ, আর্থিক লেনদেন ও বর্তমান প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা
গ্রামীণ ই-কমার্সের সম্ভাব্যতা দেখে দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীরাই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে লজিস্টিকস এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নে এই বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গ্রামীণ পণ্য নিয়ে সফলভাবে কাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
চালডাল ডট কম ও স্বপ্ন: এই বড় রিটেইল চেইন ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো একটি শক্তিশালী সরবরাহ চেইন গড়ে তুলেছে, যার মাধ্যমে তারা সরাসরি কৃষক বা উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

দারাজ: দারাজের মতো মার্কেটপ্লেসগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মে গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা সেকশন তৈরি করে দিচ্ছে, যার মাধ্যমে দেশজ ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য দেশের বৃহৎ ক্রেতাগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।

বিশেষায়িত প্ল্যাটফর্ম: খাসফুড বা ভাই ভাই এগ্রো-এর মতো কিছু বিশেষায়িত উদ্যোগ রয়েছে, যারা শুধু অর্গানিক বা মানসম্মত গ্রামীণ পণ্য নিয়ে কাজ করছে।

এফ-কমার্স: ফেসবুকভিত্তিক বাণিজ্য গ্রামীণ পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে কাজ করছে। বহু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিজস্ব ফেসবুক পেজ খুলে তাদের গ্রামের বা খামারের পণ্য বিক্রি করে সফল হচ্ছেন।

আর্থিক লেনদেন সহজীকরণের ক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) যেমন বিকাশ, নগদ বা রকেট গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এর পাশাপাশি, এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও সহজ লেনদেনের জন্য কম ডিজিটাল সাক্ষরতা সম্পন্ন ব্যবহারকারীদের জন্য ভয়েস-নির্দেশিত বা ছবি-নির্দেশিত অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক বাজার এবং সরকারি নিয়ম-নীতি
বাংলাদেশের গ্রামীণ কিছু পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ই-কমার্সের মাধ্যমে এই পণ্যগুলোকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, বিশেষ করে সরকারি নিয়ম-নীতি এবং কর সংক্রান্ত জটিলতা।

প্রতিবন্ধকতা
রপ্তানির জটিল প্রক্রিয়া: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সরাসরি পণ্য রপ্তানির প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।ভ্যাট ও ট্যাক্সের বোঝা: ই-কমার্সের মাধ্যমে রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর ভ্যাট ও ট্যাক্সের জটিলতা অনেক সময় ছোট উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে।
লজিস্টিকস ও সার্টিফিকেশন: আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মান, প্যাকেজিং, এবং সার্টিফিকেশন সংক্রান্ত কঠোর নিয়ম রয়েছে, যা গ্রামীণ উৎপাদকদের জন্য মেনে চলা কঠিন।

সমাধানের উপায়
রপ্তানি নীতি সহজীকরণ: সরকার যদি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করে একটি ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করে, তাহলে তা অনেক সহায়ক হবে।
ভ্যাট ও ট্যাক্স ছাড়: নির্দিষ্ট ধরনের গ্রামীণ ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য রপ্তানির ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স ছাড় দেয়া যেতে পারে।
সহায়তা কেন্দ্র: রপ্তানি বিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি জেলায় সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে।

ই-কমার্স কেবল একটি বাণিজ্যিক মাধ্যম নয়, এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলছে। এটি প্রান্তিক কৃষক এবং কারিগরদের ক্ষমতায়ন করছে, তাদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করছে এবং দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোকে নতুন জীবন দিচ্ছে। যদিও কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবে সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব।

আগামী দিনে, যখন দেশের প্রতিটি গ্রামে উন্নত ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছাবে এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়বে, তখন ই-কমার্স সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। এটি কেবল আর্থিক সমৃদ্ধি আনবে না, বরং গ্রামীণ সমাজকে আরও আত্মনির্ভরশীল ও উন্নত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *