ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স: বাংলাদেশের প্রেক্ষিত সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এটি কেবল বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, বরং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) জন্যও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের এক সহজ উপায়। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য, যেখানে এসএমই খাত দেশের জিডিপির প্রায় ২৫% এবং শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের ৮০% অবদান রাখে, ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স হতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক নতুন ইঞ্জিন।
কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে হলে আমাদের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। এই লেখায় আমরা বাংলাদেশের ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের সামগ্রিক প্রেক্ষিত, বর্তমান অবস্থা, প্রতিবন্ধকতা, সমাধানের উপায় এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
দেশীয় পণ্য রপ্তানির সুযোগ
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশীয় পণ্য বিদেশে পাঠানো এখন আর কোনও কল্পকাহিনী নয়, বরং বাস্তব। আমাদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, জামদানি, মসলিন, পাটজাত পণ্য, চামড়ার সামগ্রী, কারুপণ্য ইত্যাদি বিদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পেতে পারে। এ ছাড়া আচার, মধু, শুঁটকি এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে। এই ধরনের পণ্যগুলোর চাহিদা রয়েছে, কিন্তু সঠিক প্ল্যাটফর্মের অভাবে সেগুলোকে বিশ্ববাজারে পৌঁছানো কঠিন। ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স সেই প্ল্যাটফর্মটি সরবরাহ করতে পারে। এর মাধ্যমে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব।
বাংলাদেশের ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স সীমিত পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে-
অনানুষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ: অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ব্যক্তিগত বিক্রেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে বিদেশে তাদের পণ্য বিক্রি করছেন। এই বিক্রেতারা সাধারণত আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকে পেমেন্ট গ্রহণের জন্য অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম, যেমন হুন্ডি, বা বিদেশে থাকা পরিচিতদের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেন। পণ্য পরিবহনের জন্য তারা কুরিয়ার সার্ভিস বা ডাক বিভাগের সেবা ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিতে লেনদেন ও পরিবহনের কোনও সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় ঝুঁকি অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সীমিত উপস্থিতি: কিছু প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, যেমন অ্যামাজন, ইবে, বা আলিবাবাতে সীমিত পরিসরে তাদের পণ্য বিক্রি করে। তবে এই ধরনের প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়া এবং সেখানে সফলভাবে ব্যবসা করা অনেক জটিল। এসব প্ল্যাটফর্মের নিয়মাবলী, পেমেন্ট পদ্ধতি এবং লজিস্টিক সাপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় এখনও বাংলাদেশের সাধারণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজলভ্য নয়।
সরকারি নিয়ম-নীতি: বর্তমানে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা নেই। সাধারণত পণ্য রপ্তানির প্রচলিত নিয়ম-কানুন ও শুল্ক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক পদ্ধতি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। একটি সহজ ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় উদ্যোক্তারা প্রায়শই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার হন।
প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সকে জনপ্রিয় ও কার্যকর করতে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে-
১. আইনি ও নীতিগত জটিলতা:
সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব: ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের জন্য কোনো স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় ব্যবসায়ীরা প্রায়শই আইনি জটিলতা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন।
শুল্ক প্রক্রিয়া: রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক নির্ধারণ ও তা পরিশোধের প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ।
উপাত্ত সুরক্ষা আইন: অনলাইনে লেনদেনের ক্ষেত্রে উপাত্ত সুরক্ষা এবং সাইবার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনের অভাব রয়েছে।
২. পেমেন্ট সিস্টেমের দুর্বলতা
আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের অভাব: পেপ্যাল, স্ট্রাইপ-এর মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেমেন্ট গেটওয়েগুলো বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়।
ফরেন এক্সচেঞ্জ: বিদেশি মুদ্রায় পেমেন্ট গ্রহণ ও তা টাকায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া জটিল।
৩. লজিস্টিক ও ডেলিভারি ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
উন্নত লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব: দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি, উন্নত প্যাকেজিং এবং ট্র্যাকিং সিস্টেমের অভাব রয়েছে।
উচ্চ শিপিং খরচ: আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসগুলো তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় বাধা।
ডাক বিভাগের সীমাবদ্ধতা: বর্তমানে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সীমিত পরিসরে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনে কাজ করছে। তাদের ইএমএস (এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস) এবং আন্তর্জাতিক পার্সেল সেবাগুলো ব্যবহার করে বিদেশে পণ্য পাঠানো সম্ভব। তবে এই সেবাগুলোর গতি, ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং সার্বিক লজিস্টিক ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে।
৪. প্রযুক্তিগত ও দক্ষতাগত ঘাটতি
ডিজিটাল দক্ষতার অভাব: অনেক উদ্যোক্তাই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ নন।
সাইবার নিরাপত্তা: অনলাইনে প্রতারণা এবং ডেটা সুরক্ষার ঝুঁকি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায় এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সকে জনপ্রিয় করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে-
১. নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
সুস্পষ্ট নীতিমালা: সরকারের উচিত দ্রুত একটি স্বতন্ত্র ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স নীতিমালা তৈরি করা, যেখানে পেমেন্ট, লজিস্টিক, শুল্ক এবং আইনগত বিষয়গুলো সহজ ও স্বচ্ছভাবে উল্লেখ থাকবে।
শুল্ক প্রক্রিয়া সহজীকরণ: ই-কমার্স পণ্যের জন্য একটি সহজ ও স্বয়ংক্রিয় শুল্ক নির্ধারণ ও পরিশোধের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
২. পেমেন্ট সিস্টেমের উন্নয়ন
পেপ্যাল ও অন্যান্য গেটওয়ে: সরকারের উচিত পেপ্যাল, স্ট্রাইপ-এর মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে দেশে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
দেশীয় পেমেন্ট ব্যবস্থা: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজ করতে আধুনিক প্রযুক্তি ও নীতিমালা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা।
৩. লজিস্টিক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ
ডাক বিভাগের আধুনিকীকরণ: বাংলাদেশ ডাক বিভাগকে আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে শক্তিশালী করা যেতে পারে। ডাক বিভাগ তাদের বিশাল নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে পণ্যের সংগ্রহ, প্যাকেজিং এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সহায়তা করতে পারে।
লজিস্টিক ইকোসিস্টেম: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একটি সমন্বিত লজিস্টিক ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা দরকার, যা কম খরচে দ্রুত পণ্য ডেলিভারি নিশ্চিত করবে।
৪. দক্ষতা বৃদ্ধি ও সচেতনতা
প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা: উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার এবং ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের নিয়মাবলী সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
সচেতনতা সৃষ্টি: অনলাইনে প্রতারণা এবং ডেটা সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক নতুন দিগন্ত। আমাদের ঐতিহ্যবাহী পণ্য, যেমন হস্তশিল্প, জামদানি, পাটজাত পণ্য-এর বিশাল চাহিদা রয়েছে বিশ্ববাজারে। এই চাহিদা পূরণ করতে পারলে তা শুধু রপ্তানি আয় বাড়াবে না, বরং হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। চ্যালেঞ্জগুলো অনেক হলেও, সঠিক নীতি ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী ডিজিটাল অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব