‘এক দেশ এক রেট’ কোন পথে বাংলাদেশের ইন্টারনেট
গত ৬ জুন বাংলাদেশ টেলিকমিনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ‘‘এক দেশ এক রেট’’ নামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারেটের জন্য নতুন ট্যারিফ ঘোষনা করে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ, করণীয় এসব সার্বিক বিষয় নিয়ে ‘এক দেশ এক রেট কোন পথে বাংলাদেশের ইন্টারনেট’ শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটরস ফোরাম (বিডিসাফ)।
ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম, সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক, ফাইবার এট হোমের চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) সুমন আহমেদ সাবির, বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান, এনটিটি লিমিটেডের সিনিয়র নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার ফকরুল আলম পাপ্পু, বিকাশ লিমিটেডের হেড অব আইটি গভর্নেন্স নাজমুল করিম এবং বিডিসাফের আহবায়ক জুবায়ের আল মাহমুদ হোসেন। আলোচনাটি সমন্বয় ও সঞ্চালনা করেন বিডিসাফের যুগ্ম-আহবায়ক মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম।
আমিনুল হাকিম বলেন, প্রান্তিক আইএসপিগুলো বিভিন্ন সিলিং বা ফ্লোর প্রাইসে যাওয়া উচিত। ছোট ছোট স্ল্যাভে প্রাইস আনা যেতে পারে। এতে লেভেল প্লে ফিল্ড নিশ্চিত করা যাবে।
এমদাদুল হক বলেন, পুরো সিদ্ধান্তটি ধোঁয়াশার জন্ম দিয়েছে। আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই সিদ্ধান্তে প্রান্তিক আইএসপিগুলো বানিজ্যিক হুমকির মুখে পড়বে। সারা বাংলাদেশে ২৪ টেরার ওপর ট্রান্সমিশন দরকার হবে। এক মাস পর যদি ক্যাশ সার্ভার তুলে নিলে বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ ট্রাফিক লস হবে। একদিকে ব্যবহারকারীর জন্য সাশ্রয়ী অন্যদিকে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের খরচ বেড়ে যাবে। সরকারের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করা উচিত। অন্যথায়, আইএসপি সঠিকভাবে সেবা দিতে অসফল হতেও পারে। আমাদের অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর সময় দেওয়া উচিত, তাতে আমরা দেখব কোথায় নিরাপত্তা ব্যাঘাত হয়। আমরা গাইডলাইন নিয়ে একটা বিভ্রান্তের মধ্যে আছি। প্রান্তিক আইএসপির জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এখনো আমরা নিতে পারিনি। প্রান্তিক পর্যায়ের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখছেনা। বিদেশি বিনিয়োগ আনার ব্যাপারে দেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। দেশেই অনেকেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘এক রেট’ আনার জন্য যে সময়ে আসা দরকার সেই সময়ে এখনো আমরা পৌঁছেছি কিনা ভাবতে হবে। ট্রান্সমিশন বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত। দুই এক বছর পর হয়ত ট্রান্সমিশন কস্ট সহনীয় পর্যায়ে আসবে। ঢাকার আর ঢাকার বাইরে ট্রান্সমিশন কস্ট এখন তারতম্য আছে (১০ জি বিবেচনায়)। এক রেটে এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত। আইএসপির কোয়ালিটির ভিন্নতা নিশ্চিত কিভাবে করা হবে। মার্কেট কম্পিটিশন কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে ভাবা উচিত। প্রান্তিক পর্যায়ে কোয়ালিটি নিয়েও ভাবা উচিত। সার্ভিসের হাইরেরকিতে লেয়ার অনুযায়ী যে খরচের তারতম্য আছে তা বিবেচনা করা উচিত। এমনভাবে করা উচিত যাতে প্রান্তিক আইএসপি ৫০০ টাকায় যাতে ভাল সার্ভিস দিতে পারে, তখন এটি অবশ্যই বাস্তবায়ন করা যায়। জেলা পর্যায়ে ভাল কানেক্টিভিটি আছে। উপজেলা পর্যায়ে ও খারাপ না। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার গ্রাহকের সঙ্গে ফাইবার কানেক্টিভিটি দিয়ে তার ব্যবসায়িক সামঞ্জস্যতাও বিবেচনায় আনা উচিত।
মুনির হাসান বলেন, আইসিটি পলিসি হয়েছে, ব্রডব্যান্ড পলিসি হয়েছে। ২০১৫ সালের পর থেকে ব্রডব্যান্ড পলিসি আপডেট হচ্ছেনা। ৫০০ টাকায় ইন্টারনেট দেওয়ার জন্য কি ধরণের অবকাঠামো দরকার সেই নিকেশ করা দরকার। ক্যাশ সার্ভার ধরে অনেক প্রান্তিক জায়গায় নব্বই শতাংশ ইন্টারনেট সার্ভ করা যায়। ক্যাশ সার্ভার পলিসি (নীতিমালার) মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে কেননা লোকাল ট্রাফিক লোকাল রাখাই শ্রেয়। ইন্টারনেটের বিশাল জগত এখনো আমরা তুলে ধরতে পারিনি। ‘এক দেশ এক রেট’ ট্রান্সমিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় ক্যাশিং সার্ভারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুনভাবে ভাবে দরকার।
ফকরুল আলম পাপ্পু বলেন, সারা বিশ্বেই ক্যাশ সার্ভার দিয়ে ইন্টারনেট সার্ভ হচ্ছে। প্রান্তিক ব্যবহারকারীর যত কাছে ক্যাশ বা কন্টেন্ট সার্ভার রাখা যায় তত ভাল। ক্যাশ সার্ভার যদি সরিয়ে নেওয়া হয়, কোয়ালিটি বিঘ্নিত হবে। ল্যাটেন্সি বেড়ে যাবে। এতে ওভার অল ইম্প্যাক্ট হবে। এতে কস্টিং ইম্প্যাক্ট ও হবে। ক্যাশ সার্ভার তুলে নিলে ৫০% ব্যান্ড উইডথ ব্যবহার বেড়ে যাবে যার ইমপ্যাক্টে দামে পড়বে অবশ্যই। প্রান্তিক আইএসপিকে এই বেশি ব্যবহারের দাম ত তুলে আনতেই হবে। ক্যাশ সার্ভার এক ধরণের একটা প্রক্সি সার্ভার। ক্যাশ সার্ভার নিরাপত্তার জন্য হুমকি আমার কাছে মনে হয়না। ইন্টারনেটের ইকোসিস্টেমে প্রভাব পড়বে এই সিদ্ধান্ত। ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করলে গ্লোবাল সিডিএন অপারেটররাও হয়ত বিভ্রান্ত হতে পারে। ক্যাশ সার্ভারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিরাপত্তা হুমকি হতে পারে এ ধরণের কোন ধারণা আমার নেই।
নাজমুল করিম বলেন, ‘এক দেশ এক রেট’ সেবার জন্য কোয়ালিটি নিশ্চিত করা উচিত। যারা সেবা দিবে, তাদের ইস্যুগুলো যদি সমাধান করা না হয়, তাহলে এই সিদ্ধান্ত সাসটেইনেবল করা উচিত। প্রান্তিক সার্ভিস প্রোভাইডারদের ইস্যুগুলো প্রাধান্য দিয়ে এনালাইসিস করা উচিত। নিরাপত্তার জন্য সিডিএন নিরাপত্তাজনিত ইস্যু থাকার কথা না। এখান থেকে কন্টেন্ট শুধু ডাউনলোড হয়। এখানে নিরাপত্তাজনিত কন্টেন্ট সরিয়ে নেওয়ার জন্য গুগল, ফেসবুকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক শক্ত করা উচিত। প্যানডামিক সময়ে গুগল, ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এসবের কন্টেন্ট যদি শুধু স্টার টপোলজি বা ঢাকা কেন্দ্রিক হয়, তা প্রত্যাশিত নয়। বিটিআরসি কে উদ্যোগ নিতে হবে যাতে নিক্স নেটওয়ার্ক আরও কিভাবে বিস্তৃত করা যায়।
জুবায়ের আল মাহমুদ হোসেন বলেন, এই সরকারের আমলে দেশের ইন্টারনেটের দাম প্রতি এমবি ১ লক্ষ টাকা থেকে কমে ৫০০ টাকার নিচে এসেছে। আজ গ্রহক পর্যায়ের দাম নির্ধারণ প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে প্রত্যাশিত সুফল পেতে রয়ে গিয়েছে কিছু বাধা। অনতিবিলম্বে আইআইজি ও এনটিটিএন প্রাইস নির্ধারণ করা। ক্যাশ সার্ভার আছে বিধায় আমরা বাফারফ্রি ভিডিও দেখতে পারছি, এটাকে নিন্ম পর্যায় থেকে সরিয়ে নিলে ইন্টারেটের গতি আবার আগের সেই কচ্ছপ গতিতে ফিরে যাবে। ‘এক দেশ এক রেট’ বাস্তবায়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হবে। আইএসপিদের মধ্যে লেভেল পেলেংই ফিল্ড নষ্ট হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা বাস্তব স্বমত ইকো সিস্টেম তৈরি না হয় ক্যাশসমূহ আগের স্তরেই রাখতে হবে। ওভারহেড ক্যাবলের ওপরে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন।
মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম বলেন, বিটিআরসি সারা দেশের জন্য গ্রাহক পর্যায়ে ৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করেছে। ঢাকার বাইরের ব্যবহারকারীরা ব্রডব্যান্ড সংযোগের জন্য এখন এর চেয়ে বহুগুণ খরচ করেন। সেদিক বিবেচনায় নতুন নির্ধারিত মূল্য তাদের জন্য সাশ্রয়ী। এমন উদ্যোগের ফলে তাদের ইন্টারনেট সংযোগের খরচ স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এর উদ্দেশ্য মহত। কিন্তু সমস্যা হলো, এটাকে কার্যকর করার জন্য আনুষঙ্গিক উপাদানগুলোর কথা বিটিআরসি ভেবেছে কিনা। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএসপি) জন্য সেবা মূল্যের আওতায় ব্যান্ডউইডথের দাম এবং ট্রান্সমিশন ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অন্তর্ভূক্ত। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়ে খরচ কম-বেশি সমন্বয় করতে পারলেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বাদ থেকে যায়।
যেখানে এনটিটিএন ও আইআইজির জন্য ইন্টারনেটের দামের নির্ধারিত কোনো গাইডলাইন নেই, আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা দিতে কিভাবে কাজ করবে। গুগল বা ফেসবুকের মতো টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা বাড়াতে এবং দ্রুত ও সহজে সেবা দিতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেটার জন্য ক্যাশ সার্ভার বসিয়েছে। অর্থাত বাংলাদেশের কোনো থানা পর্যায়ের একজন গ্রাহক গুগল বা ফেসবুকে যখন কোনো কনটেন্ট খুঁজবে, তখন তা প্রথমবার এই টেক জায়ান্টদের মূল সার্ভারে গিয়ে হিট করবে। সেখান থেকে ওই ডেটা স্থানীয় ক্যাশ সার্ভারে জমা হবে। এরপর একই কনটেন্ট যদি আবার কেউ খুঁজতে যায়, তখন স্থানীয় সার্ভার থেকেই পাবে। ফলে পুনরায় পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। একদিকে এক দেশ এক রেট কর্মসূচি, ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাশ সার্ভার বন্ধের নির্দেশনা।
স্পিডটেস্ট-এর সূচকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি গড়ে ৩৩.৫৪ এমবিপিএস বলে ওই সূচকে উঠে এসেছে। বিটিআরসির হিসাবে, দেশে গত মার্চ শেষে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ লাখ। এক বছর আগেও সংযোগ সংখ্যা ১৮ লাখ কম ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমানে ইন্টারনেট মৌলিক চাহিদার পর্যায়ে চলে এসেছে।