এক ক্লিকে এনআইডি, তবুও নাগরিকত্বের কাগজপত্র কেন দরকার?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ সরকার যখন ‘ডিজিটাল রুপান্তর’ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তখনও নাগরিকেরা সরকারি পরিষেবা পেতে গিয়ে বারবার ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সরকারি সেবাসমূহ অনলাইনে আবেদন করার পরেও কেন নাগরিকদের সশরীরে উপস্থিত হতে হয় এবং এই দীর্ঘসূত্রিতা দূর করে ডিজিটাল সেবার পূর্ণাঙ্গ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সম্ভাব্য সমাধানগুলো কী হতে পারে।
জন্ম নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, পাসপোর্ট, ভূমি এবং বিদ্যুৎ সংযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাসমূহে সশরীরে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা ডিজিটাল সেবার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা। চাহিদা মাফিক সকল ডকুমেন্ট সরবরাহ করার পরও কেন এই দীর্ঘসূত্রিতা। অনলাইনে চাহিদা মাফিক সকল ডকুমেন্ট দেয়ার পরও আবার সেই ডকুমেন্টগুলোর হার্ডকপি সঙ্গে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এর ফলে একজন সাধারণ নাগরিকের অর্থ দুইভাবে খরচ হচ্ছে।
১. জন্ম নিবন্ধন সনদ: অনলাইন আবেদন, অফলাইন সংগ্রহ
জন্ম নিবন্ধন হলো নাগরিকের প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বর্তমানে এটি অনলাইনে আবেদন ও ফি পরিশোধ করা গেলেও, সনদ সংগ্রহের জন্য সশরীরে যেতে হয়।
অসুবিধা: মূল সনদ সশরীরে সংগ্রহ করতে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো ও সময়ক্ষেপণ হয়। এর কারণ হলো আইনি স্বাক্ষর ও সিলযুক্ত সনদের ওপর কর্তৃপক্ষের নির্ভরতা। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪ অনুযায়ী ডিজিটাল কপি এখনও চূড়ান্ত আইনি স্বীকৃতি পায়নি।
পরিসংখ্যানগত তথ্য: বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সনদের জন্য সশরীরে উপস্থিতির গড় সময় ডিজিটাল পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি।
সমাধান: ডিজিটাল স্বাক্ষরযুক্ত সনদকে আইনিভাবে মূল সনদের সমতুল্য স্বীকৃতি দেয়া।
২. ট্রেড লাইসেন্স: ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন ও দীর্ঘসূত্রিতা
ব্যবসা পরিচালনার ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন অনলাইনে করা গেলেও, চূড়ান্ত লাইসেন্স পেতে সশরীরে যেতে হয় বা দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়।
অসুবিধা: লাইসেন্স প্রদানের আগে সরেজমিন তদন্ত বাধ্যতামূলক, যা স্থানীয় কর্মকর্তা-পরিদর্শকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এতে দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়।
উপাত্তগত তথ্য: টিআইবি-এর গবেষণা অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিভিন্ন সনদ ও লাইসেন্স প্রাপ্তিতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের হার উদ্বেগজনক।
সমাধান: জিও-ট্যাগিং ও ডিজিটাল প্রমাণ ব্যবহার করে সরেজমিন তদন্তকে অনলাইন-ভিত্তিক করা। ঝুঁকির মাত্রা কম হলে লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেট করা।
৩. নাগরিকত্বের প্রমাণের বহুমাত্রিক সনদ: অপ্রয়োজনীয় বোঝা
একজন নাগরিকের এনআইডি ও পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে ‘নাগরিকত্ব সনদ’ বা ‘চারিত্রিক সনদ’ নিতে বাধ্য।
অসুবিধা: একাধিক সনদ সংগ্রহের জন্য বারবার একই ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। এর মূল কারণ, বিভিন্ন সরকারি ডেটাবেজের মধ্যে রিয়েল-টাইম তথ্য যাচাইয়ের দুর্বলতা।
সমাধান: এনআইডি নম্বরকে ‘একক ডিজিটাল পরিচিতি’ হিসেবে ঘোষণা করা এবং অন্যান্য সনদের জন্য ডকুমেন্ট না চেয়ে অনলাইনে তাৎক্ষণিক তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করা।
৪. ভূমি সেবা (নামজারি, খতিয়ান): অনুমোদনের দীর্ঘ অপেক্ষা
ভূমি সংক্রান্ত সেবাগুলো অনলাইন হওয়া সত্ত্বেও নামজারি, খতিয়ানের ক্ষেত্রে মাসের পর মাস এসিল্যান্ডের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
অসুবিধা: নামজারির ক্ষেত্রে সম্পত্তির আইনি যাচাই এবং মাঠ পর্যায়ের তদন্ত বাধ্যতামূলক। সরকারি সেবার গড় ডেলিভারি সময় ভূমি সংক্রান্ত সেবায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪-৬ গুণ বেশি।
সমাধান: আবেদনের ধরন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া এবং আইনি ঝুঁকি কম থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদন দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা।
৫. বিদ্যুৎ সেবা: বিল পরিশোধ অনলাইন, কিন্তু সংযোগে বাধা
বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন অনলাইনে করা গেলেও নতুন সংযোগ বা স্থানান্তরের চূড়ান্ত ধাপে এখনও সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন হয়।
সুবিধা: নতুন সংযোগের আবেদন ও বিল পরিশোধ শতভাগ অনলাইন হওয়ায় হয়রানি কমেছে।
অসুবিধা (ভোগান্তি): নতুন সংযোগ বা লোড পরিবর্তনের জন্য সরেজমিন পরিদর্শন এবং মিটার স্থাপনের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতির প্রয়োজন হয়, যা প্রক্রিয়াকে ধীরগতি করে।
অনলাইন সমাধান: জিও-ট্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিদর্শক কর্তৃক রিয়েল-টাইম ছবি আপলোড বাধ্যতামূলক করা।
৬. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সেবা: সশরীরে উপস্থিতির বিকল্প কি
পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ই-পেনশন এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের মতো সেবার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান।
ই-পাসপোর্ট/এমআরপি: অসুবিধা হলো বায়োমেট্রিক তথ্য গ্রহণ ও বিতরণের জন্য সশরীরে যেতে হয়। অনলাইন সমাধান: প্রতিটি উপজেলায় যৌথ বায়োমেট্রিক কেন্দ্র স্থাপন এবং চূড়ান্ত পাসপোর্ট সুরক্ষিত কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিতরণ করা।
ড্রাইভিং লাইসেন্স (স্মার্ট কার্ড): অসুবিধা হলো বায়োমেট্রিক তথ্য গ্রহণ এবং লাইসেন্স বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে অব্যবস্থাপনা।
অনলাইন সমাধান: এনআইডি ডেটাবেজ থেকে আঙুলের ছাপ যাচাই করে লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করা এবং স্মার্ট কার্ড ডাকযোগে বিতরণ করা।
ই-পেনশন: যদিও এই সেবা বর্তমানে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি ভিডিও কলের মাধ্যমে জীবিত থাকার প্রমাণপত্র অনলাইনে যাচাই করা হচ্ছে। জীবিত থাকার প্রমাণপত্র বা অন্য নথির জন্য বয়স্ক পেনশনারদের হিসাবরক্ষণ অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট: অসুবিধা হলো আবেদনকারীর রেকর্ড সরেজমিনে তদন্ত ও দীর্ঘসূত্রিতা।
অনলাইন সমাধান: তদন্তের জন্য সর্বোচ্চ ৭ দিন সময় বেঁধে দেয়া। তদন্তকারী কর্মকর্তার জন্য জিও-ট্যাগিং সহ রিপোর্ট আপলোডের একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করা।
কেন এই বাধা? সহজ সমাধান কি হতে পারে?
আমাদের ডিজিটাল যাত্রার প্রধান বাধাগুলো হলো আইনি দুর্বলতা, আন্তঃবিভাগীয় সংযোগের অভাব এবং প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাব। আইন সংস্কার করে ডিজিটাল স্বাক্ষরযুক্ত সনদকে আইনিভাবে গ্রহণযোগ্য করা।
সকল জাতীয় ডেটাবেজকে কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করে ‘ওয়ান-ক্লিক’ তথ্য যাচাই নিশ্চিত করা। আইনি ঝুঁকি কম থাকলে সময়সীমা শেষে ফাইল স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদনের প্রক্রিয়া চালু করা। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে, ঘরে বসে অনলাইনে সেবা পাওয়া সম্ভব হবে, মানুষের হয়রানি কমবে এবং ডিজিটাল রুপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে।





