পণ্য সম্পর্কে

এআই ব্রাউজার ‘অ্যাটলাস’ উন্মোচন: ক্রোমকে চ্যালেঞ্জ জানাল চ্যাটজিপিটি নির্মাতা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): সাম্প্রতিক তথ্যপ্রযুক্তি জগতে আলোড়ন তুলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর নতুন ওয়েব ব্রাউজার ‘চ্যাটজিপিটি অ্যাটলাস’-এর উন্মোচন। এই উদ্ভাবনী পদক্ষেপটি দীর্ঘদিনের বাজার রাজত্বকারী গুগল ক্রোমের একাধিপত্যের ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। ব্রাউজিংয়ের চিরায়ত ধারাকে পাল্টে দিয়ে এটি ব্যবহারকারীদের জন্য একটি ‘সুপার অ্যাসিস্ট্যান্ট’র ভূমিকা পালন করতে চাইছে, যা ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে আরও বেশি ইন্টারঅ্যাক্টিভ ও কার্যকর করে তুলবে।

কে বানালো ‘অ্যাটলাস’? এআই-ব্রাউজারের আসল প্রযুক্তি কী?
‘চ্যাপজিপিটি অ্যাটলাস’ তৈরি করেছে ওপেনএআই, যা তাদের বিপ্লবী চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি-এর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানটি মাইক্রোসফটের বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের অংশ। তাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যাম অল্টম্যান ব্রাউজারটির উন্মোচনের সময় এটিকে “ব্রাউজার কেমন হতে পারে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবার জন্য এক দশকে একবার আসা সুযোগ” হিসেবে বর্ণনা করেন।

ব্রাউজারটি প্রাথমিকভাবে ম্যাকওএস ব্যবহারকারীদের জন্য চালু করা হয়েছে এবং শীঘ্রই উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস প্ল্যাটফর্মেও আসার পরিকল্পনা রয়েছে। অ্যাটলাসের প্রধান ব্যবহারকারী হলেন চ্যাটজিপিটি-এর বিশাল গ্রাহক ভিত্তি, যার সাপ্তাহিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটিতে পৌঁছেছে (সূত্র: Demandsage, অক্টোবর ২০২৫)। বিশেষ করে যারা এআই-এর সুবিধা নিয়ে দ্রুত কাজ সারতে চান, তারা এটির প্রতি বেশি আগ্রহী হবেন।

অ্যাটলাসের সবচেয়ে উন্নত বৈশিষ্ট্য, যেমন- ‘এজেন্ট মোড’ (যেখানে এআই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিজার্ভেশন বুকিং বা ইমেইল লেখার মতো জটিল কাজ করতে পারে), বর্তমানে শুধুমাত্র চ্যাটজিপিটি প্লাস এবং প্রো গ্রাহকদের জন্য উন্মুক্ত, যা ওপেনএআই-এর জন্য নতুন রাজস্ব প্রবাহের একটি কৌশলগত উৎস। প্রযুক্তিগত দিক থেকে, যদিও ওপেনএআই দাবি করছে এটি নতুনভাবে তৈরি একটি এআই-কেন্দ্রিক ব্রাউজার, এটি ক্রোমিয়ামের ওপেন-সোর্স ভিত্তির ওপর নির্মিত। এটি সেই একই ভিত্তি যা গুগল ক্রোম, মাইক্রোসফট এজ সহ অন্যান্য ব্রাউজারকে শক্তি যোগায়। এই তথ্যটি একদিকে যেমন ব্রাউজারটির দ্রুত উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে এর ‘বিপ্লবী’ দাবি নিয়ে কিছুটা বিতর্কও সৃষ্টি করেছে।

গুগলের শতকোটি ডলারের সিংহাসন কি নড়বে? অ্যাটলাসের ব্যবসায়িক কৌশল
ওপেনএআই-এর এই পদক্ষেপের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি একটি শতকোটি ডলারের ব্রাউজার বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বর্তমানে গুগল ক্রোম প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বাজার অংশীদারিত্ব নিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছে। এই আধিপত্যের প্রধান ভিত্তি হলো অনুসন্ধান (Search) এবং বিজ্ঞাপন।

ওপেনএআই তার এআই মডেলের বিশাল পরিচালনা ব্যয়ের কারণে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের লোকসান গুনছে। অ্যাটলাসকে একটি নতুন রাজস্ব প্রবাহ তৈরি এবং গুগল বা অন্য প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরতা কমাতে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মাত্র ৫ শতাংশ চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকারী বর্তমানে প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন নেন। অ্যাটলাসের মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক ব্যবহারকারীকে পেইড সার্ভিসে নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে।

ব্রাউজার বাজারে প্রবেশ ওপেনএআই-কে ডেটা বিশ্লেষণ এবং প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে নিজস্ব উপার্জনের পথ তৈরি করতে সাহায্য করবে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, অ্যাটলাসের মতো ব্রাউজারগুলো হয়তো শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট থেকে কিওয়ার্ড-ভিত্তিক সার্চ এবং কনটেক্সচুয়াল বিজ্ঞাপনের দীর্ঘদিনের মডেলকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।

কারা হারাবে বাজার? অ্যাটলাসের প্রভাবে ঝুঁকিতে কোন কোন সংস্থা?
অ্যাটলাসের আগমন ওয়েব ব্রাউজিং এবং ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। এই নতুন প্রতিযোগিতার কারণে একাধিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে-

গুগল (গুগল ক্রোম ও গুগল সার্চ): অ্যাটলাস সরাসরি গুগল ক্রোমের একাধিপত্যে আঘাত হানছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি ঐতিহ্যবাহী ‘নীল লিঙ্ক’-ভিত্তিক অনুসন্ধানের পরিবর্তে কথোপকথন-ভিত্তিক এআই সার্চকে জনপ্রিয় করে তুলছে। ব্যবহারকারীরা এখন সরাসরি এআই-এর কাছ থেকে সারসংক্ষেপ এবং উত্তর চাইবেন, যার ফলে গুগল সার্চের বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক মডেল এবং এর ট্র্যাফিক প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গুগল ইতোমধ্যেই তার ক্রোম জেমিনি এআইকে একীভূত করে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, যা প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করবে।

অন্যান্য ব্রাউজার নির্মাতারা (মাইক্রোসফট এজ, সাফারি): বাজারের নেতৃত্বস্থানীয় ব্রাউজারগুলোতে এআই-এর গভীর ইন্টিগ্রেশন না থাকলে ব্যবহারকারীরা অ্যাটলাসের মতো নতুন এআই-কেন্দ্রিক ব্রাউজারের দিকে ঝুঁকতে পারে, ফলে বাজারের ছোট অংশীদারিত্ব নিয়ে থাকা ব্রাউজারগুলো আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

তৃতীয় পক্ষের ব্রাউজার এক্সটেনশন ও এআই টুলস: অ্যাটলাসের মতো ব্রাউজারে ইন-লাইন এআই অ্যাসিস্ট্যান্স, সারসংক্ষেপ তৈরি এবং স্বয়ংক্রিয় টাস্ক যেহেতু বিল্ট-ইন থাকছে, তাই এই কাজগুলো করার জন্য তৈরি হওয়া তৃতীয় পক্ষের ছোট এআই টুলস বা ব্রাউজার এক্সটেনশনগুলোর প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।

অনলাইন তথ্য সংগ্রাহক ও মধ্যস্থতাকারীরা: গুগল দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারকারী ও ওয়েবসাইটের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে আসছিল। অ্যাটলাসের মতো এআই ব্রাউজার সরাসরি ওয়েব পৃষ্ঠা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সারসংক্ষেপ দেয়ায় এই ‘মধ্যস্থতাকারীর’ ভূমিকা কার্যত বিলুপ্ত হতে পারে, যা কিছু অনলাইন ডেটা-হাউজ বা সার্চ অ্যাগ্রিগেটরদের জন্য ক্ষতিকর হবে।

এআই ব্রাউজিং: সুযোগ না ঝুঁকি? ইন্টারনেট ব্যবহারের ভবিষ্যৎ
চ্যাটজিপিটি অ্যাটলাস কেবল একটি নতুন ব্রাউজার নয়; এটি ইন্টারনেটের প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণের জন্য চলমান এআই যুদ্ধের একটি নতুন ফ্রন্ট। এটি দেখিয়ে দিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন আমাদের দৈনন্দিন ডিজিটাল অভ্যাসকেই পাল্টে দিতে সক্ষম। অ্যাটলাস ব্রাউজিংকে আরও নির্বিঘ্ন, ইন্টারঅ্যাক্টিভ এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগতকৃত করে তুলবে। এতে থাকা ব্রাউজার মেমোরি বা স্মৃতিশক্তি ব্যবহারকারীর কাজগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে, যা উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বাড়াবে।

তবে, এআই-চালিত ব্রাউজারের ক্ষেত্রে তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং চ্যাটবটের ‘হ্যালুসিনেশন’ সমস্যা একটি উদ্বেগের কারণ। ব্যবহারকারীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এআই দ্রুত তথ্য দিলেও চূড়ান্ত তথ্যের জন্য মানুষের বিচারবোধ অপরিহার্য। এই প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা প্রমাণ করে, ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ এখন কে সবচেয়ে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে এআইকে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে একীভূত করতে পারে, তার ওপর নির্ভরশীল। আগামী দিনগুলো নির্ধারণ করবে, চ্যাটজিপিটি অ্যাটলাস কেবল একটি জনপ্রিয় বিকল্প হিসেবে থাকবে নাকি সত্যিই গুগল ক্রোমের দীর্ঘদিনের রাজত্বের অবসান ঘটাবে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *