প্রতিবেদন

এআই’কে ভয় নয় বরং একটি টুল হিসেবে গ্রহণ করুন

মমলুক ছাবির আহমদ: অতি সাম্প্রতিক ডিপসিক (DeepSeek) সুনামিতে সারা পৃথিবীর প্রযুক্তি জগত এখন উলট পালট অবস্থা। ট্রিলিয়ন ডলারের ধ্বস। যা আমরা মোটামুটিভাবে সবাই জেনেছি। আজকের বিষয় আগামী ভবিষ্যত হবে উন্মুক্ত, সমান ও সৃজনশীল সেই বিষয়ে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী রুপান্তরের গল্প

আমার অভিজ্ঞতা
ড্রাইভারলেস উবার গত বছর আগস্টে ফিনিক্সে একটি অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উবার অ্যাপে গাড়ি ডাকার কিছুক্ষণ পর একটি জাগুয়ার এসইউভি এসে উপস্থিত হয়, যার ড্রাইভিং সিট ছিল ফাঁকা! গাড়ির ছাদে লাইডার ( LiDAR) সেন্সর, ক্যামেরা এবং রাডার বসানো ছিল এটি ছিল ওয়েমো (WAYMO) আটোনোমাস গাড়ি।

ঢাকায় গুগলের ম্যাপিং গাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা থাকলেও, ড্রাইভারবিহীন উবার এর সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হওয়াটা ছিল রোমাঞ্চকর। গাড়িটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুট প্ল্যান করল, ট্র্যাফিক সিগন্যাল মানল এবং নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছালো। এই ঘটনা আমাকে ভাবিয়ে তুললো ‘প্রযুক্তি কি আসলেই মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে’।

এআই-এর স্বয়ংক্রিয় শেখার ক্ষমতা: অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান
বর্তমানে, এআই সিস্টেমগুলো ফেডারেটেড লার্নিং এর মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে জ্ঞান শেয়ার করে। এতে, বিভিন্ন ডিভাইস তাদের স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে শিখে, সেই তথ্য সার্ভারে আপলোড করে এবং সার্ভার সেগুলোকে এনক্রিপ্টেড অবস্থায় সংরক্ষণ করে। এরপর অন্যান্য ডিভাইসগুলো সেই আপডেটেড মডেল ডাউনলোড করে নিজেদের দক্ষতা বাড়ায়।

যেমন, টেসলার অটোপাইলটে যদি একটি গাড়ি নতুন কোনো রোড প্যাটার্ন শিখে, তা পুরো নেটওয়ার্কের গাড়িগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, যা তাদের আরও দক্ষ করে তোলে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে, যেমন আমার বন্ধু কন্যা হৃদী টেক্সাকানা থেকে ডালাসে পৌঁছানোর সময় ট্রাফিক নিয়ম মেনে অনেক দ্রুত সময়ে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। যে বিষয়টি দশ বছর আগে রূপকথার গল্পের মতো মনে হতো, তা এখন অনেক জায়গায় বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কীভাবে কাজ করে?
প্রতিটি এআই মডেল স্থানীয়ভাবে ডেটা বিশ্লেষণ করে, অর্থাৎ প্রতিটি গাড়ি বা ডিভাইস নিজের তথ্য থেকে শিখে। শেখা প্যাটার্ন এবং নতুন তথ্য একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে এনক্রিপ্টেড অবস্থায় আপলোড হয়, যা অন্যান্য ডিভাইসের জন্য পাওয়া যায়। অন্যান্য ডিভাইস সেগুলো ডাউনলোড করে, যার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো হয়।

উদাহরণস্বরুপ স্বাস্থ্যসেবায় ভারতে Qure.ai-এর এআই এক্স-রে টুল গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে টিবি শনাক্ত করে এবং সার্ভারে শেয়ার করা ডেটা গ্লোবাল মডেলটিকে উন্নত করে। কৃষিতে কেনিয়ায় Microsoft-এর FarmBeats প্ল্যাটফর্ম সেন্সর দিয়ে মাটির ডেটা সংগ্রহ করে এবং সেই তথ্য শেয়ার করে, যাতে সারা বিশ্বের কৃষকরা উপকৃত হতে পারে।

টেকনোলজির ডেমোক্রেসিটাইজেশন: সবার জন্য উন্মুক্ত জ্ঞান
এআই এখন আর শুধু সিলিকন ভ্যালি বা বড় কর্পোরেশনের হাতের খেলনা নয়। ওপেন-সোর্স টুলস (যেমন TensorFlow, PyTorch) এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর সুবাদে যে কেউ এআই মডেল তৈরি করতে পারে। এর ফলে প্রযুক্তি এখন সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে এবং ছোট ছোট স্টার্টআপও বিশ্বের পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করতে পারছে।

স্টার্টআপে উদাহরণস্বরুপ বাংলাদেশের ‘কৃষি-মিত্ৰ’ অ্যাপ বাংলা ভাষায় এটি ফসলের রোগ চিহ্নিত করে এবং তার ডেটা একটি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মধ্যে শেয়ার করছে। নাইজেরিয়ার ‘Ubenwa’ এটি নবজাতকের কান্নার শব্দ বিশ্লেষণ করে শ্বাসকষ্ট শনাক্ত করে এবং সেই ডেটা বিশ্বব্যাপী গবেষকদের সঙ্গে শেয়ার করছে।

চ্যালেঞ্জ:
ডেটা প্রাইভেসি: GDPR, HIPAA ইত্যাদি নীতিমালার মাধ্যমে ডেটা শেয়ারিং নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ডিজিটাল বিভক্তি: ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোতে অফলাইন এআই সলিউশন তৈরি করা, যেন প্রযুক্তি সবার জন্য সমানভাবে উপলব্ধ হয়।

ভবিষ্যতের চিত্র: মানুষ ও এআই-এর সমন্বয়: এআই ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে কাজ করবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।

কাজের জগতে এআই-এর প্রভাব: স্বয়ংক্রিয় কাজ: ডেটা এন্ট্রি, রিপোর্ট জেনারেশন, রুটিন মেইনটেন্যান্স ইত্যাদি কাজে এআই কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

মানুষের জন্য নতুন সুযোগ:
এআই ট্রেইনার: যারা এআই মডেলগুলোকে মানবিক মূল্যবোধ শেখাবে। এথিক্যাল অফিসার: যারা এআই-এর সিদ্ধান্তে ন্যায্যতা নিশ্চিত করবে।
সৃজনশীল পেশা: আর্ট, মিউজিক, কন্টেন্ট ক্রিয়েশন এখানে মানুষের আবেগ, কল্পনা ও সৃজনশীলতা অগ্রগামী হবে।

শিক্ষায় বিপ্লব:
পার্সোনালাইজড লার্নিং: এআই প্রতিটি শিক্ষার্থীর দক্ষতা অনুযায়ী কাস্টমাইজড পাঠ্যক্রম তৈরি করবে, যাতে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষাদান করা যায়।
ভার্চুয়াল ক্লাসরুম: মেটাভার্সে ইন্টারেক্টিভ লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স, যা শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় ও কার্যকরী করে তুলবে।

প্রস্তুতি: আমরা কি তৈরি?
শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন: STEM (Science, Technology, Engineering, and Mathematics)-এর পাশাপাশি ক্রিটিক্যাল থিংকিং, ক্রিয়েটিভিটি, এবং ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের দিকে ফোকাস করা উচিত।

নীতিমালা তৈরি:
এআই-এর নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সহযোগিতা প্রয়োজন। ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (UBI)-এর মতো ধারণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে, যা প্রযুক্তির কারণে কাজ হারানো মানুষের সহায়তা করতে পারে। সচেতনতা: এআই-এর সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে সঠিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হয়। একটি সমন্বিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন: এআই প্রযুক্তি আমাদের এমন এক বিশ্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে জ্ঞান হবে মুক্ত, সিদ্ধান্ত হবে সমষ্টিগত, মানুষের মূল্য হবে তার সৃজনশীলতা ও মানবিকতায়।

এই যাত্রায় সাফল্য পেতে চাইলে আমাদের আজই পদক্ষেপ নিতে হবে: শিক্ষা, নীতিনির্ধারণ, এবং সহযোগিতার মাধ্যমে। প্রশ্ন হলো আমরা কি এই পরিবর্তনের কোথায় থাকতে চাই নেতৃত্বে, নাকি শুধু ব্যবহারকারী? একটি পদক্ষেপই পারে ভবিষ্যত বদলে দিতে!

এআইকে ভয় নয় বরং একটি টুল হিসেবে গ্রহণ করুন। যেমন লোহার ব্যবহার, চাকা আবিষ্কার, বাস্পীয় ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ, উড়োজাহাজ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি যুগে যুগে ব্যবহার করে ধাপে ধাপে এগিয়েছে, যা মানুষের সম্ভাবনাকে অনন্তকাল প্রসারিত করবে।

লেখক: মমলুক ছাবির আহমদ- ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কমপিউটার সার্ভিসেস লিমিটেড

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *