ই-কমার্স ব্যবসায়ী ও ফেসবুক উদ্যোক্তাদের সামগ্রিক দাবি
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): জুলাই-আগস্ট এর ছাত্র জনতার বিপ্লবের পর আজ তিন মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং সময়ের পরিক্রমায় ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এই পুরো সময়টাই নেতৃত্বশূন্য। অভিভাবকহীন এই সময়গুলোতে জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার বিপ্লবের সময়ের সেই ক্ষতি কতটুকু পুষিয়ে ওঠতে পেরেছে ব্যবসায়ীরা, বিগত তিন মাসে ব্যবসায়িক সার্বিক অবস্থাই বা কি ছিল। কতদূর এগিয়েছে ই-ক্যাব, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নতুন এই সরকারের সঙ্গে কিভাবে কাজ করছে বা ভবিষ্যতে করবে নেতৃত্ব হীনতায়।
বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শুরু হলেও নেতৃত্ব কখনোই ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল না। এমনকি ই-ক্যাব এর প্রতিষ্ঠাতারাও ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কখনোই। আহবায়ক কমিটিসহ যে পাঁচটি নির্বাহী পরিষদ গঠিত হয় গত দশ বছরে (৫x৯=৪৫) জন ইসি সদস্যদের মধ্যে হয়তো পাঁচ জনকেও পাওয়া যাবেনা যারা ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন।
ই-ক্যাব এর সদস্যদের মধ্যে ৯৫ ভাগ এমএসএমই ও এসএমই, ৪ ভাগ মাঝারি এবং ১ ভাগ বড় উদ্যোক্তা। কিন্তু আবার এই ১ ভাগ বড় উদ্যোক্তার মধ্যে ৯৯ ভাগই বিদেশি অথবা বিদেশি অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান। পলিসি মেকিং, সভা, সেমিনার, নিউজ বা নেতৃত্বের অনেকটা কেন্দ্রবিন্দুতে তারাই থাকেন সবসময়। এখানে দেশীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অবস্থান বা সংখ্যা পরিমাণ বেশি হলেও, সবাই একরকম ভাবে ক্ষুদ্র অংশের কাছে এক প্রকার জিম্মি।
এ সমস্ত বিদেশি অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো দেশীয় ক্ষুদ্র ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতিবন্ধকতা, অসুবিধা, তাদের জন্য সমসাময়িক পলিসি নিয়ে কথা, তাদেরকে কিভাবে ফ্যাসিলিটাইজ করা যায়, কিভাবে বিভিন্নভাবে ফান্ড, ম্যান্টরশীপ দিয়ে তাদেরকে আরও সাসটেইননেবল করা যায় সে বিষয়ে কখনোই কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি বা গাইডলাইন তৈরি হয়নি।
আমাদের বাংলাদেশ হলো ই-কমার্স এর জন্য ৩১তম লার্জেস্ট মার্কেট বিশ্বের সমস্ত দেশগুলোর মধ্যে। যার আর্থিক মার্কেট সাইজ আনুমানিক প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আনুমানিক প্রায় ১২ কোটির মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং আনুমানিক প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারি আছে। যার মধ্যে ১০ ভাগ ব্যবহারকারি মানে প্রায় ১ কোটি ব্যবহারকারি ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে অর্ডার বা সেবা নিয়ে থাকেন। যার মধ্যে ১৫ লাখ মানুষজন ই-কমার্সে অর্ডার করে থাকেন প্রায় প্রতিদিন।
দৈনিক প্রায় ৮ লাখের অধিক অর্ডার হয় এবং প্রতি অর্ডারে বাস্কেট সাইজ ১২৫০ থেকে ১৪৫০ এর মতো এবং দৈনিক ই-কমার্স এর ট্রানজেকশন হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো। ই-ক্যাব এর প্রায় ২৭০০ সদস্যসহ আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজ আছে যারা এফ কমার্স এবং ইনস্টাগ্রামে বিজনেস করে থাকেন। তিন লাখ ফেসবুক পেজ যারা বিজনেস করেন তাদের ৯৭ ভাগই এসএমই বা ছোট উদ্যোক্তা।
ই-কমার্স ব্যবসায়ী বা ফেসবুক উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের সামগ্রিক দাবিগুলো ব্যক্তি পর্যায় থেকে সরকারের বিভিন্ন মহলে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নিশ্চয়ই এগুলো বিবেচনা করবেন…….
ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তাদের স্বার্থে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেটে নিশ্চিত করা। সেটি ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা দুই পক্ষের জন্যই নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া।
ট্রেড লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে সংযুক্ত করা। আগামী ১২ মাসের জন্য ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সংক্রান্ত এবং ব্যক্তিগত সমস্ত লোনের ইন্টারেস্ট মওকুফ করা অথবা একেবারে নমিনাল পর্যায়ে নিয়ে আসা। লোনের ইনস্টলমেন্টগুলোকে শুধুমাত্র মূল টাকাগুলো নিয়ে লোনকে সচল রাখা। এটাকে আমরা টুয়েলভ মানথ পেমেন্ট হলিডে হিসেবে আখ্যা দিতে পারি।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জামানতবিহীন লোনের ব্যবস্থা করা। চিরাচরিত অফলাইন ব্যবসার মতো ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের অনেক সময় মেশিনারি, স্টাবলিশমেন্ট অনেক সময় থাকে না। এদের থাকে টেকনোলজি, গুড উইল, কাস্টমার ডাটা, কুরিয়ার ডাটা, ফেসবুক লাইক বা রিচ অথবা ওয়েবসাইটের গ্রহণযোগ্যতা। এগুলো বিবেচনা করেই লোনের ব্যবস্থা করা।
চলতি অর্থ বছরের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক সমস্ত ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করা। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করা। ফেসবুক অ্যাড এর জন্য প্রদত্ত ১৫% ভ্যাট সহ। ই-কমার্স ব্যবসাহীদের বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এসএমই উদ্যোক্তা হিসেবে সরাসরি আর্থিক প্রণোদনের ব্যবস্থা করা।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত কার্ড, অনলাইন ট্রানজেকশন, এমএফএস এর ট্রানজেকশনগুলো আগামী ৬ থেকে এক বছর পর্যন্ত চার্জ মওকুফ করা। চলমান বছরের ট্রেড লাইসেন্স রিনিউর ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র রিনিউয়াল ফি নেয়া, উৎসে কর কর্তন বাদ দিয়ে। সেন্ট্রাল লজিস্টিক ট্রাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে সবার সেলস, ব্যবসায়ের গ্রোথ এবং কোম্পানি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার ব্যবস্থা করা।
পৃথিবীর প্রায় অন্যান্য দেশে যেখানে ই-কমার্স গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেখানেই ই কমার্স ক্যাশলেস হয়েছে, বাংলাদেশে এখনও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে হয় কিন্তু ক্যাশলেস করার জন্য বাংলাদেশের এমএসএস কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই লেনদেন বেশি করতে হলে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এমএমএস কোম্পানির সার্ভিস চার্জ ০.৫ টাকাতে নামিয়ে আনা এবং পেমেন্ট গেটওয়ের চার্জও ০.৬ টাকার মধ্যেই রাখার ব্যবস্থা করা। এটির ইফেক্ট আল্টিমেটলি কাস্টমার পাবে প্রাইস কমে যাবে।
ফেসবুক অ্যাড এর ক্ষেত্রে অ্যাড লিমিট প্রত্যেকটা ই-কমার্স ব্যবসায়ীর জন্য বাৎসরিক মিনিমাম ৩০,০০০ ডলার করে দেয়া উচিত। দেশীয় পণ্য দেশের বাইরে প্রচার-প্রসারের জন্য ক্রস বর্ডার ই-কমার্সকে উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত, সেক্ষেত্রে কুরিয়ার চার্জ ভ্যাট ট্যাক্স এর বিষয়গুলোকে ক্রস বর্ডারের জন্য শিথিল করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল পোস্টাল সার্ভিসকে আরও বেশি যুগোপযোগী এবং গ্রহণযোগ্য করে ক্রস বর্ডারকে উৎসাহিত করা উচিত।
ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং ব্যবসা পুনরায় নতুন উদ্যমে চালু করতে সহায়তা করার জন্য সরকারি অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। ভাঙচুরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা।
ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা সহজীকরণ করা। ই-কমার্সের গুরুত্ব এবং এর অবদান সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ই-কমার্স খাতের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা), ফাউন্ডার কিনলে ডটকম