অন্যান্য মতামত

ই-কমার্স খাতে লজিস্টিকস: বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং ডাক বিভাগের সম্ভাবনা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ডিজিটাল রুপান্তরের স্বপ্নযাত্রায় ই-কমার্স এখন আর কোনও নতুন ধারণা নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। শহরের আধুনিক ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট ঘরটি পর্যন্ত এখন অনলাইন শপিংয়ের আওতাধীন। পণ্যের বিশাল সম্ভার হাতের মুঠোয় পেলেও, এই সুবিধার পেছনের অদৃশ্য চালিকাশক্তি হলো একটি শক্তিশালী লজিস্টিকস বা পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। কিন্তু ই-কমার্স খাতের এই বিপ্লবে দেশের সবচেয়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, অর্থাৎ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, কেন যেন ঠিকভাবে যুক্ত হতে পারেনি। একসময় যে ডাকঘর ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম, আজ কেন তা ই-কমার্সের দ্রুতগতির চাকায় শামিল হতে পারছে না। বাংলাদেশের ই-কমার্স লজিস্টিকসের বর্তমান অবস্থা, গ্রাহক ও উদ্যোক্তাদের ভাবনা এবং ডাক বিভাগের ভূমিকা নিয়ে এই লেখায় বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হলো।

বাংলাদেশের ই-কমার্স লজিস্টিকসের বর্তমান চিত্র: বেসরকারি খাতের দাপট
বর্তমানে বাংলাদেশের ই-কমার্স লজিস্টিকস খাত মূলত কয়েকটি প্রধান বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস এবং ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন কুরিয়ার, এসএ পরিবহন, স্টেডফাস্ট কুরিয়ার, রেডএক্স, পাঠাও কুরিয়ার, ই-কুরিয়ার, পেপারফ্লাই সহ স্থানীয় ও আঞ্চলিক ডেলিভারি পার্টনার।

বাজারের আকার ও ডেলিভারির পরিমাণ
বিভিন্ন গবেষণা ও ই-ক্যাব এর তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬-৭ লাখ ডেলিভারি সম্পন্ন হয়। এই সংখ্যা ঈদ এবং বিভিন্ন উৎসবের সময় আরও বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বাইরে থেকে, যা প্রমাণ করে যে ই-কমার্স শহরকেন্দ্রিকতা পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। এই বিশাল ডেলিভারি সংখ্যার মধ্যে ডাক বিভাগের মাধ্যমে ডেলিভারি হওয়া পণ্যের পরিমাণ খুবই নগণ্য, যা মোট অর্ডারের ২-৫% এর বেশি নয়। অধিকাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে যারা দ্রুত ডেলিভারি নিশ্চিত করতে চায়, তারা এখনও বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর ওপরই বেশি নির্ভরশীল।

ডেলিভারির পদ্ধতি
লাস্ট মাইল ডেলিভারি: এটি লজিস্টিকসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রক্রিয়ায় পণ্য গুদাম থেকে সরাসরি গ্রাহকের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হয়। বেসরকারি ডেলিভারি পার্টনাররা দ্রুত এই সেবা দিতে পারলেও তাদের নেটওয়ার্ক সব জায়গায় সমানভাবে বিস্তৃত নয়।

ফার্স্ট মাইল ডেলিভারি: এটি বিক্রেতার গুদাম বা দোকান থেকে ডেলিভারি পার্টনারের হাব পর্যন্ত পণ্য নিয়ে আসার প্রক্রিয়া। অনেক সময় বিক্রেতারা নিজস্ব লোকবলের মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করেন, আবার অনেক সময় ডেলিভারি পার্টনাররাই এই কাজটি করে থাকে।

রিভার্স লজিস্টিকস: এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে গ্রাহকের ফেরত দেয়া পণ্য বিক্রেতার কাছে ফেরত পাঠানো হয়। পণ্যের ত্রুটি, ভুল ডেলিভারি বা অন্য কোনও কারণে গ্রাহক পণ্য ফেরত দিতে চাইলে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এই সেবাও প্রদান করছে, যা ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হচ্ছে।

গ্রাহক ও উদ্যোক্তাদের ভাবনা: কেন ডাক বিভাগ এখনও আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠতে পারেনি
ই-কমার্স লজিস্টিকসে ডাক বিভাগের এই সীমিত ভূমিকা এবং বেসরকারি খাতের আধিপত্যের পেছনে গ্রাহক ও উদ্যোক্তা উভয়েরই কিছু সুনির্দিষ্ট ভাবনা রয়েছে।
গ্রাহক সন্তুষ্টির হার
ধীর গতি: গ্রাহকদের প্রধান অভিযোগ হলো ডাক বিভাগের ডেলিভারি প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। যখন বেসরকারি কুরিয়ারগুলো ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি দিচ্ছে, তখন ডাক বিভাগের মাধ্যমে পণ্য পেতে কয়েকদিন বা এমনকি সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।

ট্র্যাকিংয়ের অভাব: রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং সুবিধা না থাকায় গ্রাহকরা তাদের পণ্যের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন না, যা তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। যদিও সম্প্রতি ডাক বিভাগ আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পার্সেল ট্র্যাকিং সুবিধা চালু করেছে, কিন্তু এই ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি কার্যকর এবং গ্রাহকবান্ধব হয়ে ওঠেনি। অনেক ক্ষেত্রে ট্র্যাকিং তথ্য দেরিতে আপডেট হয়, অথবা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না।

দুর্বল গ্রাহক সেবা: কোনও সমস্যা হলে গ্রাহকদের অভিযোগ জানানোর এবং তার সমাধান পাওয়ার প্রক্রিয়া খুবই জটিল।

আস্থার সংকট: অনেক গ্রাহকের মনে এখনও এমন ধারণা রয়েছে যে, ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো পণ্য দেরিতে পৌঁছাতে পারে বা হারিয়ে যেতে পারে।

ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের ভাবনা ও সন্তুষ্টি
নিম্নমানের সেবা: বেশিরভাগ ই-কমার্স উদ্যোক্তা মনে করেন, ডাক বিভাগের সেবা এখনও ই-কমার্সের দ্রুতগতির চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। দ্রুত ডেলিভারি তাদের ব্যবসার জন্য অপরিহার্য।

ক্যাশ অন ডেলিভারি ইস্যু: ই-কমার্সের মোট অর্ডারের ৭০-৮০% এখনও ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ডাক বিভাগের ক্যাশ অন ডেলিভারি প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর, যার কারণে উদ্যোক্তারা তাদের টাকা সময়মতো ফেরত পান না, যা তাদের নগদ প্রবাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে।

মূল্য ও নিরাপত্তা: অনেক উদ্যোক্তা মনে করেন, ডাক বিভাগের মূল্য বেসরকারি কুরিয়ারগুলোর তুলনায় কিছুটা কম হলেও, পণ্যের নিরাপত্তার ঝুঁকি বেশি। মূল্যবান পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে তারা ডাক বিভাগকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না।

প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা: ডাক বিভাগের সিস্টেমে অর্ডার বুকিং, ট্র্যাকিং এবং পেমেন্ট ব্যবস্থাপনার আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য তাদের সঙ্গে কাজ করা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।

সরকারের নীতি এবং ডাক বিভাগের আধুনিকীকরণ: রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিংয়ের সম্ভাবনা
সরকার বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ডাক বিভাগকে আধুনিকীকরণের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে। ডিজিটাল রুপান্তর ভিশনের অংশ হিসেবে সরকার ডাক বিভাগকে একটি আধুনিক এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং সুবিধা চালু করা।

রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিংয়ের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (bdpost.gov.bd) এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে এখন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পার্সেলের ট্র্যাকিং সুবিধা দেয়া হয়। পার্সেল বুকিং করার সময় একটি অনন্য ট্র্যাকিং নম্বর দেয়া হয়, যা দিয়ে গ্রাহক তার পণ্যের অবস্থান জানতে পারেন।

আন্তর্জাতিক পার্সেল: আন্তর্জাতিক পার্সেলের ক্ষেত্রে ট্র্যাকিং ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর। আন্তর্জাতিক পোস্টাল প্রটোকল অনুযায়ী, পার্সেলের প্রতিটি ধাপ স্ক্যান করা হয়, যার ফলে গ্রাহক বিস্তারিত তথ্য পান।

দেশীয় পার্সেল: দেশীয় পার্সেলের ক্ষেত্রেও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা এখনও বেসরকারি কুরিয়ারগুলোর মতো মসৃণ নয়। অনেক সময় স্ক্যানিং প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হয়, যার ফলে ট্র্যাকিং ডেটা রিয়েল-টাইমে আপডেট হয় না। ফলে, রিয়েল-টাইম শব্দটি থাকলেও, বাস্তবে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা মিশ্র।

প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাল রূপান্তর
সেন্ট্রালাইজড ট্র্যাকিং সিস্টেম: একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেখানে প্রতিটি প্যাকেজ স্ক্যান করে রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং ডেটা আপলোড করা হবে। এটি বিক্রেতা এবং ক্রেতা উভয়কেই তাদের পণ্যের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেবে। এই ব্যবস্থাটি আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইট: একটি ইউজার-ফ্রেন্ডলি মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট তৈরি করা যেখানে গ্রাহকরা সহজেই তাদের প্যাকেজ ট্র্যাক করতে পারবে, অভিযোগ জানাতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারবে। ডাক বিভাগের বর্তমান অ্যাপ ও ওয়েবসাইটকে আরও উন্নত করা আবশ্যক।

স্বয়ংক্রিয় বাছাই ও প্যাকেজিং কেন্দ্র: প্রধান ডাকঘরগুলোতে স্বয়ংক্রিয় প্যাকেজ বাছাই ও প্যাকেজিং কেন্দ্র স্থাপন করা, যা দ্রুত এবং নির্ভুল ডেলিভারি নিশ্চিত করবে।

ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম: ক্যাশ-অন-ডেলিভারির অর্থ দ্রুততম সময়ে বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি কার্যকর ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম চালু করা। এটি নগদ প্রবাহের সমস্যা সমাধান করবে।

ব্যবস্থাপনা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
বিশেষায়িত লজিস্টিকস ইউনিট: ই-কমার্স লজিস্টিকস পরিচালনার জন্য ডাক বিভাগের মধ্যে একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা, যা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবে।

ব্যাপক কর্মী প্রশিক্ষণ: কর্মীদের ডিজিটাল প্রযুক্তি, গ্রাহক সেবা এবং আধুনিক লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনার ওপর ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান।

বেসরকারি অংশীদারিত্ব
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ: ডাক বিভাগ বেসরকারি লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব করতে পারে। এক্ষেত্রে, ডাক বিভাগ তার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সরবরাহ করবে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা এবং বিপণন সহায়তা প্রদান করবে। এটি উভয় পক্ষের জন্য একটি উইন উইন পরিস্থিতি তৈরি করবে।

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে একটি শক্তিশালী লজিস্টিকস ব্যবস্থার ওপর। ডাক বিভাগ যদি যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে নিজেদের আধুনিক করতে পারে, তাহলে এটি দেশের ই-কমার্স লজিস্টিকসের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে ওঠতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য কমে আসবে, তেমনি ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তারাও তাদের পণ্য সারা দেশে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ পাবে। এটি শুধু ডাক বিভাগের পুনর্জন্মই নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবেও কাজ করবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *