প্রতিবেদন

ই-কমার্স খাতে প্রতারণায় গ্রাহক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তরণের উপায়

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে গ্রাহক পর্যায় এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো উভয় পক্ষই উভয় পক্ষ দ্বারা প্রতারিত হওয়ার শিকার হন। যা উভয় পক্ষকেই একে অপরের প্রতি আস্থাহীনতার অবস্থান তৈরি করে। এই আস্থাহীনতা দূরত্ব যত কমবে আমাদের ই-কমার্স খাত প্রসারিত হবে। গ্রাহকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা ফিরে পেলে, প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রয় বা সেবা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি ভাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গ্রাহকদের আস্থা পায় সেক্ষেত্রে গ্রাহকরা লাভবান হবেন।

এ সমস্ত বিষয় নিয়েই বাংলাদেশের ই-কমার্স গ্রাহকরা কিভাবে প্রতারিত হন এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি, পাশাপাশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের দ্বারা কিভাবে প্রতারিত হয় এবং সেই ক্ষেত্রে তাদের কি করণীয় এ বিষয়গুলো নিয়ে আজকের আলোচনা। লিখেছেন- মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

ই-কমার্স খাতে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার কিছু সাধারণ উপায় এবং তা থেকে উত্তরণের উপায়
গ্রাহকরা যেভাবে প্রতারিত হন
অনেক সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো অবিশ্বাস্যরকম কম মূল্যে পণ্য বিক্রির লোভনীয় অফার দেয়, যা বাস্তবে হয় না। গ্রাহকরা এসব অফারে আকৃষ্ট হয়ে টাকা পরিশোধ করার পর আর পণ্য পান না। যেমন- ৫০% বা ১০০% ক্যাশব্যাক, অবিশ্বাস্য কম মূল্যে পণ্য ইত্যাদি। অনেক সময় বিখ্যাত ব্যক্তি বা ইনফ্লুয়েন্সারদের দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়, যা গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে। পণ্য ডেলিভারির আগেই সম্পূর্ণ বা বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়, যা পরে আর ফেরত পাওয়া যায় না।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা

প্রতারিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে যায়, যেমন – কাস্টমার সার্ভিস নম্বর বন্ধ বা ইমেইলের উত্তর না দেয়া। কিছু ক্ষেত্রে প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পর তাদের ওয়েবসাইট বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়। ই-কমার্সের আড়ালে এমএলএম বা পিরামিড স্কিমের মতো ব্যবসা পরিচালনা করা হয়, যেখানে নতুন গ্রাহক যোগ করে লাভ করার প্রলোভন দেখানো হয়।

টাকা পরিশোধ করার পর গ্রাহক হয়তো পণ্যটি পানই না, অথবা অর্ডার করা পণ্যের পরিবর্তে অন্য কোনো ত্রুটিপূর্ণ বা নিম্নমানের পণ্য পান।বিক্রেতা পণ্য ডেলিভারির জন্য অতিরিক্ত সময় নেয়, যা গ্রাহকের আস্থা কমিয়ে দেয়। অনেক সময় মাসের পর মাস চলে গেলেও পণ্য ডেলিভারি হয় না। অনেক অসাধু বিক্রেতা কেবল অগ্রিম অর্থ পরিশোধের অপশন রাখেন, যাতে গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার আগে প্রতারিত হতে পারে।

কিছু প্রতারক আসল ই-কমার্স সাইটের মতো দেখতে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য চুরি করে। ছবিতে বা বর্ণনায় পণ্যের গুণগত মান ভালো দেখালেও বাস্তবে পণ্যটি নিম্নমানের হয়। আসল পণ্যের পরিবর্তে অন্য কোনো নিম্নমানের বা ভুল পণ্য সরবরাহ করা হয়, যা গ্রাহকের প্রত্যাশা পূরণ করে না। প্রতারিত হওয়ার পর গ্রাহকরা বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না, কারণ তাদের কাস্টমার সার্ভিস নম্বর বন্ধ বা তারা ইমেইলের উত্তর দেয় না।

গ্রাহকদের জন্য প্রতারণা থেকে বেরিয়ে আসার উপায়
কোনও ই-কমার্স সাইট থেকে কেনাকাটা করার আগে সেটির রিভিউ ও রেটিং ভালোভাবে দেখে নিন। বিশেষ করে, ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটে অন্যান্য গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা কেমন, তা যাচাই করুন। সম্ভব হলে ক্যাশ অন ডেলিভারি অপশন বেছে নিন। এতে পণ্য হাতে পাওয়ার পর অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ থাকে, ফলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমে। দেশের সুপরিচিত এবং দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনাকাটা করার চেষ্টা করুন। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ডিজিটাল বিজনেস আইডি (ডিবিআইডি) চালু করেছে। যে প্রতিষ্ঠানের ডিবিআইডি আছে, সেটিকে তুলনামূলকভাবে বেশি বিশ্বাস করা যেতে পারে।

ই-কমার্সে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে এবং আস্থা বজায় রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
সচেতনতা বৃদ্ধি
অত্যন্ত লোভনীয় অফার পরিহার করুন। অস্বাভাবিক উচ্চ ছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার দেখলে সতর্ক হন। বাস্তবে এত বড় ছাড় প্রায়শই প্রতারণার লক্ষণ। যে ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ থেকে কিনছেন, সেটির বিশ্বস্ততা যাচাই করুন। প্রতিষ্ঠানটি কতদিনের পুরনো, তাদের ঠিকানা, ফোন নম্বর, কাস্টমার রিভিউ ইত্যাদি ভালোভাবে দেখুন। যদি পরিচিত না হয় বা নতুন হয়, তাহলে সতর্ক থাকুন।

অনলাইনে কেনাকাটার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যক্তিগত বা আর্থিক তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। অন্যান্য গ্রাহকদের রিভিউ এবং রেটিং ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। নেতিবাচক রিভিউ বেশি থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করা থেকে বিরত থাকুন। বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নাম নকল করে বা সামান্য পরিবর্তন করে প্রতারকরা ওয়েবসাইট তৈরি করে। আসল ব্র্যান্ডের নামের বানান ও লোগো সঠিক আছে কিনা, তা ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।

নিরাপদ লেনদেন পদ্ধতি
সম্ভব হলে ক্যাশ অন ডেলিভারি অপশন বেছে নিন। এতে পণ্য হাতে পাওয়ার পর অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ থাকে, ফলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসক্রো সার্ভিস চালু করেছে, যেখানে ক্রেতার পরিশোধিত অর্থ তৃতীয় পক্ষের কাছে জমা থাকে এবং পণ্য হাতে পাওয়ার পর সেই অর্থ বিক্রেতাকে দেয়া হয়। এই ধরনের সার্ভিস ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। ইমেইল, এসএমএস বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা কোনও অপরিচিত বা সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। এই লিঙ্কগুলো ফিশিং বা ম্যালওয়্যার হতে পারে।

আইনগত ও নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা
সরকার ডিজিটাল বিজনেস আইডি (ডিবিআইডি) প্রদান কার্যক্রম শুরু করেছে। যাচাই করুন যে প্রতিষ্ঠানটির ডিবিআইডি আছে কিনা। এটি তাদের বৈধতার একটি সূচক। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)-এর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত কিছু নিয়মকানুন মেনে চলে। সদস্যপদ যাচাই করে নিতে পারেন। যদি প্রতারিত হন, তাহলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, বা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ দায়ের করুন।

অন্যান্য সতর্কতা
যেকোনও ওয়েবসাইটে কেনাকাটার আগে তাদের গোপনীয়তা নীতি এবং শর্তাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন। সুরক্ষিত এবং পরিচিত পেমেন্ট গেটওয়ে (যেমন: ব্যাংক পেমেন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং) ব্যবহার করুন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যক্তিগত বা আর্থিক তথ্য অনলাইনে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।

এই ধাপগুলো অনুসরণ করে এবং সতর্কতা অবলম্বন করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনাকাটার সময় গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে গ্রাহক থেকে প্রতারিত হয় এবং সেই ক্ষেত্রে কি করণীয়
প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে গ্রাহক থেকে প্রতারিত হয়
কিছু গ্রাহক বা অসাধু চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচুর সংখ্যক জাল অর্ডার দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ডেলিভারি খরচ বাড়ে এবং অনেক সময় পণ্য ফেরত আসে, যা তাদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। গ্রাহক হয়তো আসল পণ্যটি ব্যবহার করে বা নষ্ট করে অন্য কোনও নিম্নমানের পণ্য ফেরত দেয়ার চেষ্টা করে, অথবা ব্যবহৃত পণ্যকে নতুন দেখিয়ে ফেরত দিতে চায়। চুরি করা ক্রেডিট কার্ড বা ভুয়া পেমেন্ট তথ্যের মাধ্যমে পণ্য কিনে নেয়। যখন আসল কার্ড হোল্ডার অভিযোগ করে, তখন পেমেন্ট বাতিল হয় এবং প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

গ্রাহক পণ্য পাওয়ার পরেও পেমেন্ট অস্বীকার করে বা ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করে যে পণ্য পায়নি, ফলে প্রতিষ্ঠানকে অর্থ ফেরত দিতে হয়। কিছু গ্রাহক অফার বা কুপনের অপব্যবহার করে একাধিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে বা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ডিসকাউন্ট হাতিয়ে নেয়। অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে অর্ডার দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে প্রতারিত করা। গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট পণ্য অর্ডার করে এবং ডেলিভারির পর অন্য কোনও পণ্য দিয়ে তা পরিবর্তন করে আসল পণ্যটি রেখে দেয়।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রতারণা থেকে বেরিয়ে আসার উপায়
শক্তিশালী অর্ডার ভেরিফিকেশন সিস্টেম-
ফোন নম্বর এবং ইমেইল ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা। বড় অর্ডারের ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে অর্ডার নিশ্চিত করা। অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক অর্ডার প্যাটার্ন পর্যবেক্ষণ করা।

সুরক্ষিত পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার-
পিসিআই ডিএসএস (পেমেন্ট কার্ড ইন্ডাস্ট্রি সিকিউরিটি স্ট্যান্ডার্ড) কমপ্লায়েন্ট পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করা। ফ্রড ডিটেকশন টুলস ব্যবহার করা যা সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করতে পারে।

রিটার্ন পলিসি কঠোর করা-
রিটার্ন পলিসি সুনির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট হওয়া উচিত। ফেরত নেয়া পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করার জন্য কঠোর প্রক্রিয়া অনুসরণ করা। প্রয়োজনে পণ্য ফেরতের সময় ভিডিও রেকর্ড বা ছবি তোলা।

ক্যাশ অন ডেলিভারির ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা-
ক্যাশ অন ডেলিভারি অর্ডারের ক্ষেত্রে ডেলিভারি চার্জ অগ্রিম নেয়ার ব্যবস্থা করা। অপরিচিত বা সন্দেহজনক এলাকার ক্যাশ অন ডেলিভারি অর্ডার সীমিত করা। মূল্যবান পণ্যের ক্ষেত্রে ক্যাশ অন ডেলিভারি অপশন না রাখা।

প্রোমোশন ও ডিসকাউন্ট অপব্যবহার রোধ-
একটি নির্দিষ্ট আইপি অ্যাড্রেস বা ফোন নম্বর থেকে একাধিক অ্যাকাউন্ট তৈরি রোধ করা। কুপন কোড বা ডিসকাউন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করা।

আইনগত সহায়তা গ্রহণ-
প্রতারণার শিকার হলে দ্রুত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ দায়ের করা। আইনি পরামর্শ নেয়া এবং প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি রাখা।

গ্রাহক ডেটা বিশ্লেষণ-
আগের প্রতারণার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে প্যাটার্ন খুঁজে বের করা। সন্দেহজনক কার্যকলাপের জন্য ডেটা অ্যানালিটিক্স টুলস ব্যবহার করা।

সফটওয়্যার এবং টেকনোলজি আপগ্রেডেশন-
অ্যান্টি-ফ্রড সফটওয়্যার এবং সুরক্ষা টুলস ব্যবহার করা। ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা জোরদার করা যাতে ফিশিং বা সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ডেলিভারি পার্টনারদের সঙ্গে সমন্বয়-
ডেলিভারি পার্টনারদের সতর্ক করে দেয়া যাতে তারা সন্দেহজনক অর্ডার সম্পর্কে রিপোর্ট করে। ডেলিভারির সময় পণ্যের সঠিক ছবি বা ভিডিও ধারণ করার অনুরোধ করা।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে এবং একটি নিরাপদ অনলাইন বাণিজ্যিক পরিবেশ বজায় রাখতে পারে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *