ইন্টারনেট খাতে বিদেশি আধিপত্য, দেশীয় আইএসপি রক্ষার দাবি
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ‘ডিজিটাল রুপান্তর’ গড়ার স্বপ্নের মাঝেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে একটি গভীর নীতিগত বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডার (এফটিএসপি) এবং সেলুলার মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএমএসপি)’ সংক্রান্ত নতুন গাইডলাইন দেশের ব্রডব্যান্ড পরিষেবা শিল্পকে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) আশঙ্কা প্রকাশ করছে, এই নীতিমালা কার্যকর হলে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের মূল্য কমপক্ষে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, যা কোটি কোটি ব্যবহারকারী এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করবে।
প্রস্তাবিত নীতিমালা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই নীতিমালার মূল ঝুঁকি দুটি: প্রথমত, গ্রাহকের ওপর সরাসরি অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি; দ্বিতীয়ত, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ: শূন্য থেকে রাজস্বের বোঝা
আইএসপিএবি-এর তথ্য ও পরিসংখ্যান এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, নতুন গাইডলাইনে আর্থিক বোঝা চাপানোর মাধ্যমে সার্ভিস প্রোভাইডারদের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা সরাসরি গ্রাহকের ওপর বর্তাবে।
ক) অতিরিক্ত রেভিনিউ শেয়ারিং ও তহবিল
প্রস্তাবিত এফটিএসপি গাইডলাইনে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের ওপর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ারিং এবং ১ শতাংশ সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড-এর নতুন আবশ্যকতা যোগ করা হয়েছে। পূর্বে ন্যাশনওয়াইড, ডিভিশন এবং ডিস্ট্রিক্ট ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার লাইসেন্সের জন্য এই রেভিনিউ শেয়ারিং এবং সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড-এর হার ছিল শূন্য শতাংশ (০%)। অর্থাৎ, এই খাতে হঠাৎ করে মোট ৬ দশমিক ৫ শতাংশের অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা চাপানো হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত ব্রডব্যান্ড পরিষেবা প্রদানের পরিচালন ব্যয়কে রাতারাতি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অতিরিক্ত ফি-এর কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার মূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর অর্থ হলো, ৫০০ টাকার প্যাকেজটি কিনতে ১০০ টাকা বেশি দিতে হবে, যার মূল্য দাড়াবে ৬০০ টাকা; আর ১০০০ টাকার প্যাকেজের মূল্য হবে ১২০০ টাকা। ইন্টারনেট যখন মৌলিক সেবা, তখন এই ‘ডিজিটাল ট্যাক্স’ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের পরিবারগুলোর ডিজিটাল অভিগম্যতাকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করবে।
খ) বহুস্তরের শুল্ক ও লাইসেন্স ফি বৈষম্য
বর্তমানে এই খাতটি এমনিতেই বহুস্তরের শুল্কের ভারে জর্জরিত (ব্যান্ডউইডথের ওপর ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আইটিসি/বিএসসিসিএল, আইআইজি এবং এনটিটিএন-এর মাধ্যমে ১৮ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ারিং। এর ওপর নতুন করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের রাজস্বের বোঝা খাতটিকে স্থবির করে দেবে। এ ছাড়াও, দেশীয় ন্যাশনওয়াইড আইএসপি লাইসেন্স রিনিউয়ালে ২৫ লাখ টাকা ফি ধার্য করার প্রস্তাব করা হলেও, আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য সেই ফি অপেক্ষাকৃত কম রাখা হয়েছে। এই বৈষম্য দেশীয় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে।
অসম প্রতিযোগিতা ও দেশীয় শিল্পের পতন
গাইডলাইন-এর দ্বিতীয় বিপজ্জনক অংশটি হলো মোবাইল অপারেটরদের (সিএমএসপি) জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করা।
ক) লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটিতে প্রবেশ:
প্রস্তাবিত সিএমএসপি গাইডলাইন মোবাইল অপারেটরদের ফিক্সড ওয়্যারলেস একসেস (এফডব্লিউএ) এবং হোম/অফিস প্রাঙ্গনে ফাইবার কানেক্টিভিটি ডেপ্লয়মেন্টের অনুমতি দিচ্ছে। ফাইবারভিত্তিক লাস্ট মাইল কানেকশন দেয়া ঐতিহাসিকভাবে ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস (এফটিএস) লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশীয় আইএসপিদের ডোমেইন। বিপুল পুঁজি থাকা মোবাইল অপারেটররা এই খাতে প্রবেশ করলে, তারা খুব দ্রুত বাজার দখল করে ফেলবে।
খ) ডিজিটাল অগ্রদূত ও কর্মসংস্থানের সংকট:
দেশের প্রতিটি প্রান্তে ব্রডব্যান্ডের আলো পৌঁছে দেয়ার অগ্রদূত ছিলেন এই দেশীয় ছোট আইএসপি উদ্যোক্তারাই। মোবাইল অপারেটরদের প্রবেশের কারণে প্রায় ২,৭০০ ছোট ও দেশীয় আইএসপি চরম আনফেয়ার কম্পিটিশনের মুখে পড়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে। এর ফলস্বরূপ, এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাজার হাজার স্থানীয় কর্মীর জীবন-জীবিকাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে, যা দেশের রুরাল ইকোনমিকে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নীতিগত বৈপরীত্য এবং সংশোধনের পথ
সরকার যখন সাশ্রয়ী মূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে এক দেশ, এক রেট স্লোগান দিচ্ছে, তখন এই নীতিমালা মূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পথ তৈরি করছে। এই নীতিগত বৈপরীত্য নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে। জনস্বার্থ রক্ষায় আইএসপিএবি নিম্নলিখিত সাত দফা দাবি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে:
১. সিএমএসপি সংশোধন (এফডব্লিউ ও ফাইবার): মোবাইল অপারেটরদের (সিএমএসপি) গাইডলাইন থেকে ফিক্সড ওয়্যারলেস একসেস (এফডব্লিউ) এবং হোম/অফিস ফাইবার কানেক্টিভিটি ডেপ্লয় করার অনুমতি বাতিল করতে হবে।
২. আর্থিক বোঝা হ্রাস: এফটিএসপি গাইডলাইন থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ারিং ও ১ শতাংশ সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড এবং উচ্চ লাইসেন্স ফি বাতিল বা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
৩. ওয়াইফাই/আইএসএম ব্যান্ড ব্যবহার: সিএমএসপি গাইডলাইন থেকে সার্ভিস ডেলিভারির জন্য আইএসএম/ওয়াইফাই ব্যান্ডের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. অবকাঠামো শেয়ারিং: এফটিএসপি-এর জন্য অ্যাক্টিভ অবকাঠামো শেয়ারিং সংক্রান্ত গাইডলাইন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
৫.আইপিটিএসপি নির্দেশিকা: ইন্টারনেট প্রোটোকল টেলিফোনি সার্ভিস প্রোভাইডার (আইপিটিএসপি), এসএমএস সার্ভিস ও মোবাইল ডায়ালার বিষয়ে বিস্তারিত ও স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।
৬. বৈষম্য দূরীকরণ: এফট্এসপি এবং জেলা এফটিএসপি-এর মধ্যে সার্ভিস বৈষম্য রাখা যাবে না।
এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো দুর্বল হবে এবং জনজীবনে সরাসরি আর্থিক চাপ পড়বে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতি আবেদন, জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে রাজস্বের স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যের ঊর্ধ্বে স্থান দিন। এই গাইডলাইন দ্রুত সংশোধন করে দেশের ইন্টারনেট শিল্প এবং জনগণের ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিত করাই হোক ডিজিটাল রুপান্তর গড়ার প্রথম পদক্ষেপ।





