প্রতিবেদন

অগ্নিনির্বাপণে স্মার্ট প্রযুক্তি: বিশ্বে বিপ্লব, বাংলাদেশও প্রস্তুত হচ্ছে

ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ (তুষার): অগ্নিকাণ্ড একটি ভয়াবহ দুর্যোগ, যা প্রতি বছর হাজারও মানুষের জীবন ও সম্পদ কেড়ে নিচ্ছে। আগুন একটি অদৃশ্য আতঙ্ক, যা মুহূর্তে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। কিন্তু এখন আগুন নেভানোর পদ্ধতিও আগুনের গতির মতো দ্রুত হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই অগ্নিনির্বাপণে যুক্ত করেছে ড্রোন, রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), সেন্সর, স্যাটেলাইট মনিটরিং এবং স্মার্ট ডেটা বিশ্লেষণ ব্যবস্থা।

জাপান: স্মার্ট সেন্সর ও আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা
জাপান প্রযুক্তিনির্ভর অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বিশ্বের অন্যতম অগ্রগামী দেশ। দেশটির বড় শহরগুলোয় বিল্ডিংগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ (IoT) নির্ভর ফায়ার সেন্সর। যা তাপমাত্রা, ধোঁয়া বা কার্বন মনোক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দমকল বিভাগে বার্তা পাঠায়। এ ছাড়া, টকিও ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এখন এআই ভিত্তিক সিস্টেম ব্যবহার করছে, যা শহরের ট্রাফিক ডেটা বিশ্লেষণ করে দ্রুততম রুটে ফায়ার ট্রাক পৌঁছানোর নির্দেশনা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র: ড্রোন ও রোবট ফায়ার ফাইটার
যুক্তরাষ্ট্রের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন ও রোবট। ক্যালিফোর্নিয়ার বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ‘থার্মাল ইমেজিং ড্রোনস’ ব্যবহার করা হয়, যা তাপমাত্রা ও আগুনের গতিপথ নিরীক্ষণ করে দমকল বাহিনীকে আগুনের বিস্তার রোধে সহায়তা করে। এ ছাড়া ‘থার্মাইট আরএস৩’ নামের রোবট এখন লস অ্যাঞ্জেলস ফায়ার ডিপার্টমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মানুষের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করে পানি ও ফোম ছিটিয়ে আগুন নেভাতে পারে। অগ্নিকাণ্ডের সময় গুগল ও নাসা-এর যৌথ স্যাটেলাইট ডেটাও ব্যবহার করা হয় আগুনের বিস্তার ট্র্যাক করতে।

সিঙ্গাপুর: স্মার্ট সিটি ও রিয়েল-টাইম মনিটরিং
স্মার্ট সিটি সিঙ্গাপুরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায়। ভবনগুলো সংযুক্ত ‘স্মার্ট নেশন সেন্সর’ প্ল্যাটফর্ম-এর সঙ্গে, যা রিয়েল-টাইমে আগুন, ধোঁয়া, তাপমাত্রা ও গ্যাস লিকেজ শনাক্ত করে। এখানকার এসসিডিএফ স্মার্ট ফায়ার স্টেশনগুলোতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম, ডিজিটাল মানচিত্র ও এআই চালিত ডেটা অ্যানালাইসিস টুল, যা প্রতিটি ঘটনার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। এখানে এআই কমান্ড সেন্টার প্রতিটি ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে কন্ট্রোল রুমে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পাঠায়, ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে সেকেন্ডেরও কম।

ডেনমার্ক: টেকসই প্রযুক্তি ও ডেটা-নির্ভর সাড়া
ডেনমার্কের ফায়ার সার্ভিস এখন ‘প্রিডেক্টিভ ফায়ার এনালিটিক্স’ ব্যবহার করছে, যা পূর্বের ঘটনার ডেটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ডের জায়গা চিহ্নিত করতে পারে। এই পদ্ধতি শুধু দ্রুত প্রতিক্রিয়া নয়, বরং আগাম পরিকল্পনার সুযোগ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে সৌরচালিত ফায়ার ড্রোন এবং হাইড্রোজেনচালিত ফায়ার ট্রাক ব্যবহারে দেশটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়া: রোবট ফায়ার ফাইটার ও ভার্চুয়াল ট্রেনিং
সিউলে তৈরি ‘ফায়ারফাইটিং রোবট এলআর০১’ বিপজ্জনক কারখানা বা তেল স্থাপনাগুলোতে মানুষের পরিবর্তে আগুন নেভায়। এ ছাড়া ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে- যা ঝুঁকি ছাড়াই দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক।

অস্ট্রেলিয়া: স্যাটেলাইট ও এয়ারবর্ন মনিটরিং
বনাঞ্চলের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়া ব্যবহার করছে ‘সেন্টিনেল স্যাটেলাইট ফায়া্র ডিটেকশন সিস্টেম’। এ ছাড়া, ড্রোন ও হেলিকপ্টারে স্থাপিত ইনফ্রারেড ক্যামেরা আগুনের তীব্রতা ও দিক নির্ধারণ করে মাঠে থাকা দমকলকে তাৎক্ষণিক তথ্য দেয়।

ফ্রান্স: স্মার্ট সিটি ইন্টিগ্রেশন ও রোবট টহল
প্যারিসে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থাকে একীভূত করা হয়েছে ‘স্মার্ট সিটি ড্যাশবোর্ড’-এর সঙ্গে। এতে রিয়েল-টাইমে ট্রাফিক, আবহাওয়া ও বিল্ডিং তথ্য একত্রে পাওয়া যায়। কিছু এলাকায় ফায়ারবোট নামে স্বয়ংক্রিয় রোবট টহল দেয়, যা তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন শনাক্ত করলে সেন্ট্রাল সার্ভারে বার্তা পাঠায়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নিয়ন্ত্রিত ফায়ার সিস্টেম
দুবাই সিভিল ডিফেন্স সম্প্রতি চালু করেছে ‘এআই কমান্ড কন্ট্রোল রুম’- যেখানে স্যাটেলাইট ইমেজ, ড্রোন ফিড ও বিল্ডিং সেন্সর ডেটা একত্রে বিশ্লেষণ হয়। ড্রোনগুলো ছাদে পানি বা ফোম স্প্রে করতে পারে, আবার আগুনের উৎসে কার্বন-ডাইঅক্সাইড বোমা ফেলতেও সক্ষম।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
বাংলাদেশেও ফায়ার সার্ভিস এখন স্মার্ট প্রযুক্তির পথে হাঁটছে। ডিজিটাল ফায়ার ম্যাপিং, জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং স্মার্টফোন অ্যাপ-এর মাধ্যমে দ্রুত সাড়া দেয়ার উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, দ্রুত ও কার্যকর অগ্নিনির্বাপণে প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ দুইয়ের সমন্বয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভবন নিরাপত্তা, সেন্সর নেটওয়ার্ক এবং রিয়েল-টাইম ডেটা ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশও চাইলে আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে অগ্নিনির্বাপণে যে প্রযুক্তিগুলো আরও ব্যবহারযোগ্য হতে পারে
এআই নির্ভর আগুন পূর্বাভাস: পুরনো অগ্নিকাণ্ডের ডেটা বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ও সময় চিহ্নিত করা সম্ভব।
স্মার্ট বিল্ডিং ফায়ার নেটওয়ার্ক: বড় ভবনে সেন্সর, অ্যালার্ম ও পানি ছিটানো সিস্টেমকে একত্রিত করে ক্লাউডের সঙ্গে সংযুক্ত করা।
রোবট ফায়ার ফাইটার ও অটোমেটেড ড্রোন: ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে (যেমন গার্মেন্টস কারখানা বা গ্যাস প্ল্যান্ট) রোবট ব্যবহার করলে মানবজীবনের ঝুঁকি কমবে।
ডিজিটাল ফায়ার ম্যাপিং: জিআইএস ভিত্তিক সিস্টেম তৈরি করে কোন এলাকায় কত ফায়ার স্টেশন ও হাইড্রেন্ট আছে তা রিয়েল-টাইমে দেখা যাবে।
স্মার্ট ট্রাফিক কোঅর্ডিনেশন: জরুরি সাড়া দেয়ার সময় সিগন্যাল অটো-কন্ট্রোলের মাধ্যমে ফায়ার ট্রাকের জন্য রাস্তা ফাঁকা রাখা সম্ভব।

অগ্নিনির্বাপণ শুধু আগুন নেভানো নয়- এটি প্রযুক্তি, পরিকল্পনা ও প্রতিরোধের সমন্বিত প্রয়াস। বিশ্বের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়, যত দ্রুত প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যাবে, তত বেশি জীবন ও সম্পদ রক্ষা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ালে ফায়ার সার্ভিসের কার্যকারিতা কয়েকগুণ বাড়তে পারে, সেই সঙ্গে বাঁচানো যাবে অসংখ্য প্রাণ ও কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *