প্রতিবেদন

অগ্নিঝুঁকির অগ্নিপরীক্ষা: বাংলাদেশের সক্ষমতা ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটি দেশের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লজিস্টিকস শৃঙ্খলে এক বিশাল আঘাত। এটি শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা নয়; গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক বিপর্যয় (চকবাজার, সীতাকুণ্ড, পোশাক কারখানা) প্রমাণ করে, অগ্নিঝুঁকি এখন একটি জাতীয় নিরাপত্তা সংকটে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (KPI) ঝুঁকির মুখে পড়ায়, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক আস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের বাস্তব সক্ষমতা যাচাই করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা অপরিহার্য।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (FSCD): বর্তমান সক্ষমতা ও প্রযুক্তির ঘাটতি
বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা প্রতিবারই সর্বোচ্চ সাহসিকতা দেখান, কিন্তু তাদের সরঞ্জাম ও কৌশল আধুনিক বিশ্বের তুলনায় বহু পিছিয়ে।

বর্তমান সক্ষমতা: FSCD প্রধানত প্রচলিত হোসপাইপ, ওয়াটার টেন্ডার এবং কিছু প্রাথমিক পাম্পের ওপর নির্ভরশীল। তাদের প্রশিক্ষণে মানবীয় সাহসিকতার দিকটি শক্তিশালী হলেও, অগ্নিনির্বাপণে দ্রুত সাড়াদানের ব্যবস্থা দুর্বল।

দুর্বলতার মূল কারণ: রাজধানী ঢাকায় যানজট নিরসনের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় এবং পানির উৎসের অভাবে ফায়ার সার্ভিস ইউনিটগুলো দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। এ ছাড়া, আধুনিক রোবোটিক ফায়ারফাইটিং ইউনিট বা অটোমেটেড ডিটেকশন সিস্টেমের মতো উচ্চ প্রযুক্তির সরঞ্জামের তীব্র ঘাটতি রয়েছে।

প্রয়োজনীয়তা (আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে): FSCD-এর প্রয়োজন থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা যা ধোঁয়ার মধ্যে আগুনের উৎস খুঁজে নিতে পারে; দ্রুত স্থাপনার কাঠামো বিশ্লেষণ করার জন্য ড্রোন-ভিত্তিক ম্যাপিং সিস্টেম এবং সংকীর্ণ স্থানে প্রবেশে সক্ষম রোবোটিক ইউনিট।

কাঠামোগত ত্রুটি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দুর্বলতা
দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে (যেমন বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্পাঞ্চল) অগ্নি নিরাপত্তার তিনটি মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে-
১) ফায়ার কোড লঙ্ঘন: পুরোনও স্থাপনাগুলোতে ফায়ার কোড ও ফায়ার-রেটেড কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের অভাবের কারণে আগুন দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
২) ডিটেকশন সিস্টেমের ত্রুটি: সরাসরি অ্যালার্ট ইন্টিগ্রেশন সিস্টেম না থাকায় আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
৩) বিশেষ নির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব: রাসায়নিক বা বৈদ্যুতিক আগুন নেভানোর বিশেষায়িত সরঞ্জাম (যেমন কার্গো ভিলেজে প্রয়োজন) সীমিত।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিশ্ব অভিজ্ঞতা
আধুনিক বিশ্বে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা এখন ডেটা অ্যানালিটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল।
সরাসরি অ্যালার্ট সিস্টেম (IFAS): গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ইন্টিগ্রেটেড ফায়ার অ্যালার্মিং সিস্টেম (IFAS) স্থাপন জরুরি। এটি আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে জিও-লোকেশন ও ঝুঁকির প্রকারভেদসহ সরাসরি ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তাৎক্ষণিক অ্যালার্ট পাঠাবে।

ড্রোন ও আইওটি: বড় শিল্প এলাকায় থার্মাল সেন্সর যুক্ত ড্রোন এবং গুদামগুলোতে আইওটি (IoT) সেন্সর বসানো প্রয়োজন, যা গ্যাস লিক বা অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিও দ্রুত রিপোর্ট করবে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
সিঙ্গাপুর: ওয়্যারলেস সেন্সরভিত্তিক মনিটরিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে আগুনের সূত্রপাত নির্ণয় এবং উচ্চ-বৃদ্ধি ভবনগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া: উচ্চ তাপমাত্রায় মানবজীবন ঝুঁকিমুক্ত রাখতে রোবোটিক ফায়ারফাইটার এবং ধ্বংসস্তূপ সরানোর বিশেষ রোবট ব্যবহার করে।
জার্মানি: স্মার্ট অ্যালার্ম ও ট্রাফিক ডেটা ইন্টিগ্রেশন ব্যবহার করে জরুরি মুহূর্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুটে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, যা নির্বাপণ দলের দ্রুত সাড়া নিশ্চিত করে।

প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা
এই সমস্যা মোকাবিলায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নীতিগত ও কাঠামোগত সমাধান প্রয়োজন।
নীতিগত ও আর্থিক বাধ্যবাধকতা
বীমা ও আর্থিক উদ্দীপক: যেসব প্রতিষ্ঠান আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপন করবে, তাদের জন্য বীমা প্রিমিয়ামের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার নীতি নিতে হবে। অন্যদিকে, ফায়ার কোড লঙ্ঘনকারীদের প্রিমিয়াম বহুগুণ বাড়ানো বা কভারেজ বাতিল করা উচিত।

শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কঠোর করা: সরকারি তদন্তে অবহেলা বা ফায়ার কোড লঙ্ঘনের কারণে আগুন লাগার ঘটনা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তার জন্য কঠোর দেওয়ানী ও ফৌজদারি শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা আবশ্যক। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য।

কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান
ফায়ার হাইড্রেণ্ট নেটওয়ার্ক তৈরি: প্রতিটি মেট্রোপলিটন শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা ও প্রধান রাস্তার পাশে মাটির নিচে একটি সুসংগঠিত হাই-প্রেসার ফায়ার হাইড্রেণ্ট নেটওয়ার্ক স্থাপন বাধ্যতামূলক করা উচিত। এর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে ওয়াসা এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মধ্যে স্থায়ী আন্তঃসংস্থা কমিটি গঠন করা দরকার।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেল: অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য পিপিপি মডেল চালু করা যেতে পারে। বেসরকারি ফায়ার সেফটি ফার্মগুলো লিজ বা সেবার ভিত্তিতে প্রযুক্তি সরবরাহ করবে, যা সরকারের এককালীন বিনিয়োগের চাপ কমাবে।

কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমপ্লায়েন্স প্ল্যাটফর্ম: ফায়ার সেফটি সংক্রান্ত সকল লাইসেন্স, নবায়ন, পরিদর্শন রিপোর্ট এবং কমপ্লায়েন্স ট্র্যাকিংয়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন পোর্টাল চালু করা প্রয়োজন। এটি সরকারি দপ্তরের কাজে স্বচ্ছতা আনবে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ছাড়পত্র প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজ করবে।

প্রাথমিক ও বহনযোগ্য নির্বাপক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা
ক্ষুদ্র ব্যবসা, অফিস বা ব্যক্তিগত যানবাহনে দ্রুত অগ্নিকাণ্ড দমনের জন্য সহজে বহনযোগ্য আধুনিক সরঞ্জামাদির ব্যবহার বৃদ্ধি করা আবশ্যক-
অটো ফায়ার বল: স্বয়ংক্রিয় নির্বাপক যন্ত্র, যা বৈদ্যুতিক প্যানেল বা ছোট গুদাম ঘরে আগুনের সংস্পর্শে এলেই বিস্ফোরিত হয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
ফায়ার ব্ল্যাংকেট: ফাইবার গ্লাসের তৈরি বহনযোগ্য কম্বল, যা তেল বা চর্বির আগুন (রান্নাঘরের আগুন) ঢেকে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে নিভিয়ে দিতে পারে।
জলীয় রাসায়নিক স্প্রে: কমপিউটার সার্ভার বা সংবেদনশীল যন্ত্রপাতির আগুন নেভানোর জন্য উপযোগী স্প্রে প্রযুক্তি, যা ন্যূনতম ক্ষতি করে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
স্মার্ট স্মোক ডিটেকশন: ওয়াই-ফাই যুক্ত স্মার্ট অ্যালার্ম, যা ধোঁয়া বা তাপ শনাক্ত করে সরাসরি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বা স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠায়।

সামাজিক ও প্রশিক্ষণগত সক্ষমতা বৃদ্ধি
কমিউনিটি ও লোকাল লেভেলে সক্ষমতা: ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিউনিটি ভলান্টিয়ার ফোর্স গঠন করে প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। এই প্রশিক্ষিত ফার্স্ট রেসপন্ডার দল আগুনের বিস্তার রোধে প্রথম সাড়া দেবে।

ডিজিটাল প্রশিক্ষণ: গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কর্মীদের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) বা সিমুলেশন সফটওয়্যার-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি, যা কর্মীদের ঝুঁকি ছাড়াই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বাড়াবে এবং আতঙ্ক হ্রাস করবে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের এই অগ্নিকাণ্ড দেখিয়েছে যে, মানবীয় প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এখন জাতীয় অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য একটি আবশ্যিক বিনিয়োগ। দেশকে বৈশ্বিক মানচিত্রে নিরাপদ প্রমাণ করতে সরকারকে অবশ্যই শুধুমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন না করে, জাতীয় ফায়ার কোড কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে রক্ষায় এই অগ্নিপরীক্ষায় জয়ী হওয়ার জন্য সুদূরপ্রসারী, প্রযুক্তিভিত্তিক এবং সমন্বিত সমাধান গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *