স্কুলে ব্যর্থ, ইউটিউবে উদ্ধার? স্ব-শিক্ষণের উত্থান
মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: যখন স্কুল পরিণত হয় সার্টিফিকেট ফ্যাক্টরিতে, তখন ইন্টারনেট খুলে দেয় শেখার নতুন দরজা। বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষা ক্রমশই একটি সার্টিফিকেট ফ্যাক্টরিতে পরিণত হচ্ছে। এখানে মূল লক্ষ্য থাকে- বই মুখস্থ করো, পরীক্ষা দাও, গ্রেড পাও। এর বাইরে শেখার আনন্দ, প্রশ্ন করার সাহস, কিংবা সৃজনশীলতার চর্চা প্রায় অদৃশ্য। ফলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে গেলেও তাদের প্রকৃত শেখার তৃষ্ণা পূরণ হয় না। শিক্ষার কাঠামো এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যেখানে জ্ঞানের গভীরতা নয়, বরং পরীক্ষার ফলাফলই সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি।
কিন্তু যেখানে স্কুল ব্যর্থ, সেখানে নতুন এক বিপ্লব ঘটছে নীরবে। ইন্টারনেট- ইউটিউব, কোরসেরা, খান একাডেমি, ফেসবুক গ্রুপ বা টেলিগ্রাম চ্যানেল শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে ওঠছে বিকল্প শ্রেণিকক্ষ। সেখানে তারা পাচ্ছে ব্যবহারিক জ্ঞান, জীবন ও ক্যারিয়ারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, আর সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনভাবে শেখার সুযোগ।
এই পরিবর্তনের মূল কারণগুলো স্পষ্ট। প্রথমত, আমাদের শিক্ষা এখনও পুরোপুরি পরীক্ষাকেন্দ্রিক। শেখার আনন্দ বা জ্ঞান অর্জনের তাগিদ নেই, আছে শুধু মুখস্থবিদ্যা আর নম্বরের দৌড়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক ঘাটতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইউনেস্কোর ২০২৩ সালের তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় ১:৪৬, যেখানে আন্তর্জাতিক মান ১:৩০। ফলে একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত মনোযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তৃতীয়ত, পাঠ্যক্রম সময়োপযোগী নয়। ডিজিটাল লিটারেসি, সমালোচনামূলক চিন্তা, সমস্যা সমাধান বা ভবিষ্যতের চাকরির জন্য জরুরি দক্ষতা পাঠ্যবইয়ে নেই বললেই চলে।
ফলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে বিকল্প খুঁজছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা (২০২২) বলছে, বাংলাদেশের ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি শেষে পাঠ্যবই পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ হয়। অথচ বিটিআরসি জানাচ্ছে দেশে বর্তমানে ১৩ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ তরুণ শিক্ষার্থী এখন পড়াশোনার সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ক্লাসে যা বোঝা যায়নি, তা তারা ইউটিউব টিউটোরিয়াল থেকে শিখে নিচ্ছে কখনও গণিতের সূত্র, কখনও কোডিং, আবার কখনও বিদেশে পড়াশোনার প্রস্তুতি।
এখানে একটি স্পষ্ট কারণ পরিণতি চিত্র দেখা যায়। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে ব্যবহারিক শিক্ষার দিকে, যা তারা খুঁজে পাচ্ছে অনলাইনে। শিক্ষক সংকট তাদের নির্ভরশীল করে তুলছে ডিজিটাল গাইডের ওপর। অপ্রাসঙ্গিক সিলেবাস তৈরি করছে নতুন শেখার চাহিদা, আর সেই প্রয়োজন মেটাচ্ছে ইন্টারনেট। এই সমীকরণে স্কুল ধীরে ধীরে হয়ে ওঠছে কেবল সার্টিফিকেট বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান, আর ইন্টারনেট হয়ে ওঠছে প্রকৃত শেখার বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে এই প্রবণতার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে। ইতিবাচক দিক হলো শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ- একজন ঢাকার অভিজাত স্কুলের ছাত্র আর একজন প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে একই অনলাইন ভিডিও দেখে শিখতে পারছে। শেখার সুযোগ এখন ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে সবার কাছে। কিন্তু বিপদের দিক হলো, ইন্টারনেটের অ্যালগরিদম মানের চেয়ে জনপ্রিয়তাকে প্রাধান্য দেয়। ফলে মানসম্পন্ন কনটেন্ট চাপা পড়ে যায় চটকদার শর্টকাট ভিডিওর নিচে। এতে শিক্ষার্থীরা হয়তো দ্রুত উত্তর পাচ্ছে, কিন্তু গভীর বোঝাপড়া হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে শিক্ষার ভবিষ্যৎ তাই আজ এক দ্বিধার মুখে। একদিকে পরীক্ষাকেন্দ্রিক স্কুলব্যবস্থা, যা কেবল সার্টিফিকেট দিচ্ছে কিন্তু শেখাচ্ছে না। অন্যদিকে ইন্টারনেট-ভিত্তিক স্ব-শিক্ষণ, যা শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে, কিন্তু এর মান নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ রয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি স্কুলকে কেবল সার্টিফিকেট ফ্যাক্টরি বানিয়ে রাখব, নাকি ইন্টারনেট-ভিত্তিক শিক্ষাকে মূল কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের পথ খুলে দেব?
লেখক: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম- সভাপতি বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস) এবংব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লি.





