প্রতিবেদন

সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা: অস্ট্রেলিয়ার নজির, বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া সরকার ১৬ বছরের কম বয়সী কিশোর-কিশোরীদের জন্য ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক সহ প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে অ্যাক্সেস বন্ধ করার যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে এক গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অনলাইন ঝুঁকি কমানোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যেই বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়া কিশোরদের মধ্যে উদ্বেগ, একাকিত্ব, ঘুমের সমস্যা, খাদ্যাভ্যাসের ব্যত্যয় এবং মানসিক চাপ বাড়াতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে, দ্রুত উন্নয়নশীল বাংলাদেশেও এই বিষয়ে গভীরভাবে আলোচনা জরুরি। যেখানে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, সেখানে অস্ট্রেলিয়ার এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশ কি একই পথে হাঁটতে পারে? বা বাংলাদেশের বাস্তবতায় এর কারণ ও পরিণতি কী হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: ব্যবহার ও ঝুঁকি
বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের (১০ থেকে ১৭ বছর) মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের হার অত্যন্ত বেশি। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। তবে এদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি শিশু জানে না কীভাবে অনলাইনে সুরক্ষিত থাকতে হয়।

বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের শহুরে কিশোর-কিশোরীরা দৈনিক গড়ে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় স্ক্রল করে বা গেমিংয়ে ব্যয় করে। এই সময়ে কিশোরীরা সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে এবং কিশোরেরা গেমিং বা ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করে। এই অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলস্বরূপ দেশে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মমর্যাদা হ্রাস এবং আসক্তির মতো সমস্যা বাড়ছে। সাইবার বুলিং, প্রতারণা, ভুল তথ্য বা আপত্তিকর কনটেন্টের শিকার হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। তবে যেসব কিশোর অন্তর্মুখী বা লাজুক, সোশ্যাল মিডিয়া তাদের বন্ধু তৈরি ও নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে; সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা তাদের সামাজিকীকরণ বা আত্মপ্রকাশে বাধা দিতে পারে।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি: ঘুম ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর প্রভাব
অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিশেষভাবে সতর্ক করছেন-
ঘুমের সমস্যা: স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন মেলাটোনিন-এর উৎপাদনকে বাধা দেয়, যা ঘুম আসার সংকেত দেয়। এ ছাড়া ফিয়ার অব মিশিং আউট মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং ঘুম আসতে দেয় না।

খাদ্যাভ্যাসের ব্যত্যয়: সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রায়শই অবাস্তবভাবে নিখুঁত শরীরের ছবি তুলে ধরা হয়। এই ছবিগুলো দেখে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের শরীরের সঙ্গে নেতিবাচকভাবে তুলনা করে, যা তাদের মধ্যে তীব্র আত্মমর্যাদা হ্রাস এবং বডি ডিসমরফিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলে তারা ভুল খাদ্যাভ্যাস বা খাদ্যাভ্যাসজনিত জটিলতায় ভোগে।

নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ এবং অর্থনৈতিক বিবেচনা
বাংলাদেশ যদি অস্ট্রেলিয়ার পথে হাঁটে, তবে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে-
প্ল্যাটফর্মের ওপর কঠোর দায়: অস্ট্রেলিয়ায় আইন ভাঙলে প্ল্যাটফর্মগুলোকে ৫০ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ জরিমানা আন্তর্জাতিক বিগ-টেক কোম্পানিগুলোর ওপর কার্যকর করা বাংলাদেশের আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।

আইনি বিতর্ক ও স্বাধীনতা: অস্ট্রেলিয়ায় এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কারণ দেখিয়ে সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশেও ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন আয় করে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে দেশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাজার ও সরকারের রাজস্ব আহরণে প্রভাব পড়তে পারে। উপরন্তু, কিশোর-কিশোরীদের যদি ১৬ বছর পর্যন্ত এই প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে দূরে রাখা হয়, তবে তারা ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে পড়তে পারে, যা ভবিষ্যতে ডিজিটাল অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নিয়ন্ত্রক ও মানদণ্ড: অস্ট্রেলিয়ার মতো ইসেফটি কমিশনার-এর মতো শক্তিশালী স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে নেই। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (১৩ বা ১৪ বছর) উপেক্ষা করে কঠোর ১৬ বছর বয়সসীমা নির্ধারণের যৌক্তিকতা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য সামগ্রিক বিবেচনা ও কার্যকর করণীয়
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার চেয়ে বরং নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষা-এর সমন্বয়ে একটি কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
শিক্ষার মাধ্যমে সুরক্ষা: বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ডিজিটাল নাগরিকত্ব এবং অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়গুলো আবশ্যিক করা উচিত। শিশুদের ভুয়া খবর বা বিভ্রান্তিকর তথ্য যাচাই করার প্রক্রিয়া শেখাতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো জোরদার: বাংলাদেশে বিদ্যালয়ভিত্তিক পেশাদার কাউন্সেলিং এবং কিশোরদের জন্য সহজলভ্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো যথেষ্ট দুর্বল। কেবল নিষেধাজ্ঞা সমস্যার মূল সমাধান দেবে না, যদি না এই অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা হয়।

পারিবারিক ও অভ্যাসগত পরিবর্তন: পরিবারে একটি নির্দিষ্ট স্ক্রিন টাইম রুটিন তৈরি করা আবশ্যক। বিশেষজ্ঞদের মতে, দৈনিক ২ ঘণ্টার বেশি বিনোদনমূলক স্ক্রিন টাইম এড়িয়ে চলাই শ্রেয় এবং ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘণ্টা আগে সকল ডিভাইস বন্ধ রাখতে হবে।

অভিভাবকের সক্রিয় ভূমিকা: অভিভাবকদের অবশ্যই সন্তানের ডিজিটাল জীবনে একজন নিয়ন্ত্রক না হয়ে সহযাত্রী হতে হবে। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্ষতিকর কনটেন্ট ফিল্টার করা যেতে পারে।সামাজিকীকরণের বিকল্প: কিশোরদের পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দেয়া, যা তাদের বাস্তব জীবনের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

অস্ট্রেলিয়ার কঠোর পদক্ষেপের বিপরীতে বাংলাদেশে সমন্বিত শিক্ষা, প্ল্যাটফর্মের ওপর কঠোর জবাবদিহিতা এবং শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধন এই ত্রিমুখী কৌশলই কিশোরদের জন্য একটি সুরক্ষিত ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *