মস্তিষ্কের দুয়ারে প্রযুক্তি: নিউরোটেকনোলজি ও নিউরালিংকের মহাবিপ্লব
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বৈপ্লবিক প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নিউরোটেকনোলজি (Neurotechnology)। এটি মানব মস্তিষ্ক এবং প্রযুক্তির মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। একসময় যা ছিল কেবলই কল্পবিজ্ঞান, আজ তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে ‘ব্রেইন-কমপিউটার ইন্টারফেস’ (বিসিআই) প্রযুক্তির হাত ধরে। এই প্রযুক্তি মানুষের চিন্তা ও মস্তিষ্ক তরঙ্গকে সরাসরি ডিজিটাল কমান্ডে রূপান্তরিত করতে সক্ষম।
কল্পনা থেকে বাস্তবতা এবং ইলন মাস্কের এই প্রচেষ্টার নেপথ্যে রয়েছে দুটি মূল লক্ষ্য-
প্রথমত: চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব আনা যেমন- পক্ষাঘাত, স্মৃতিভ্রংশ বা পারকিনসন্স-এর মতো স্নায়ুঘটিত রোগের উন্নত চিকিৎসা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত: মানবজাতিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করা।
ইলন মাস্কের মতে, এআই-এর দ্রুত উত্থানের সঙ্গে মানব মস্তিষ্ককে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এই ধরনের সরাসরি ডিজিটাল সংযোগ অপরিহার্য।
শুরুর কথা: নিউরালিংক এবং প্রতিযোগীদের অগ্রগতি
নিউরালিংক আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালে যাত্রা করে। তবে বিসিআই প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯২০-এর দশকে ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি (ইইজি) আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। নিউরালিংকের মূল উদ্ভাবন হলো আক্রমণাত্মক বা ইনভেসিভ বিসিআই প্রযুক্তি, যেখানে মস্তিষ্কের ভেতরে ছোট ইলেক্ট্রোড স্থাপন করা হয়। তবে এই খাতে কেবল ইনভেসিভ টেকনোলজিই নয়, নন-ইনভেসিভ বিসিআই প্রযুক্তিও গেমিং বা মনোযোগ বাড়ানোর মতো ক্ষেত্রে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
নিউরালিংক যখন ইনভেসিভ বিসিআই-এর পথে হাঁটছে, তখন তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিঙ্করণ খুলি না কেটেই শিরা বা রক্তনালীর মাধ্যমে ডিভাইস স্থাপনের মিনিমালি-ইনভেসিভ প্রযুক্তি নিয়ে বড় সফলতা পেয়েছে। তাদের রোগীরা বর্তমানে শুধু চিন্তার মাধ্যমে স্মার্ট হোম ডিভাইস ও অত্যাধুনিক ভিআর/এআর হেডসেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির সাফল্য প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে।
উপযোগিতা ও পরিসংখ্যানগত তথ্য: চিকিৎসাক্ষেত্রে বিপ্লব ও নিয়ন্ত্রক অনুমোদন
নিউরোটেকনোলজির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার দেখা যাচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের জীবনে আশার আলো দেখা যাচ্ছে-
পক্ষাঘাত নিরাময় ও সক্ষমতা পুনরুদ্ধার: নিউরালিংকের একাধিক রোগী (যেমন – নোল্যান্ড আর্বাগ) সফলভাবে চিপ গ্রহণ করেছেন। তাঁরা এখন শুধু কমপিউটার কার্সর নিয়ন্ত্রণ নয়, জটিল ভিডিও গেম খেলা, ডিজিটাল আর্ট তৈরি এবং দ্রুত অনলাইন যোগাযোগের মতো কাজও শুধু চিন্তার মাধ্যমে করছেন। এই সাফল্য কোয়াড্রিপ্লেজিয়া আক্রান্তদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বিশাল পদক্ষেপ।
স্নায়ুরোগের চিকিৎসা ও দৃষ্টি পুনরুদ্ধার: নিউরালিংক ব্লাইন্ডসাইট নামক দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে, যা ইউএস ফেডারেল গভর্নমেন্টের কাছ থেকে ব্রেকথ্রু স্ট্যাটাস পেয়েছে। এ ছাড়াও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ডিমেনশিয়া এবং আলঝাইমার্স সহ স্নায়ুজনিত রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিসিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নিয়ন্ত্রক অনুমোদন: স্পিচ এবং স্পিচ রিস্টোরেশনের জন্য নিউরালিংক এফডিএ (এফডিএ) থেকে ব্রেকথ্রু ডিভাইস ডেজিগনেশন অর্জন করেছে, যা এই প্রযুক্তির চিকিৎসা সম্ভাবনাকে আরও নিশ্চিত করে।
অর্থনৈতিক ও বিশ্লেষণাত্মক দিক: বাজার, প্রতিযোগিতা এবং নৈতিক ঝুঁকি
নিউরোটেকনোলজি খাতটি দ্রুতগতিতে একটি বিশাল অর্থনৈতিক বাজারে পরিণত হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষণ: বিশ্বব্যাপী বিসিআই বাজারটি বর্তমানে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি এবং এটি ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির কারণ হল- স্বাস্থ্যসেবা, গেমিং এবং সামরিক খাতে এর ব্যবহার বৃদ্ধি। এই খাতে বিপুল পরিমাণে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ আসছে, যার বেশিরভাগটাই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক-এর মতো দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলগুলোতে।
চ্যালেঞ্জ ও নৈতিক বিতর্ক: এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই প্রযুক্তি নিয়ে গভীর নৈতিক বিতর্ক বিদ্যমান। সমালোচকরা আশঙ্কা করছেন যে, হ্যাকাররা যদি মস্তিষ্কে স্থাপিত চিপের অ্যাক্সেস পায়, তবে তারা কেবল তথ্য চুরি করবে না, বরং ব্যবহারকারীর আবেগ বা আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে, যা ব্রেইন হ্যাকিং নামে পরিচিত। এই বিতর্ক কগনিটিভ লিবার্টি বা চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ভবিষ্যতের অ্যাপ্লিকেশন
নিউরোটেকনোলজি ভবিষ্যতে আমাদের যোগাযোগ, কাজ করার পদ্ধতিকে আমূল বদলে দেবে। মেটাভার্স বা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি-এর জগতে শুধু চিন্তার মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া সম্ভব হবে। এমনকি, মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি রেকর্ড বা প্লে-ব্যাক করার ধারণাও ভবিষ্যতে গবেষণার কেন্দ্রে আসতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এই প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এক বিশাল সুযোগ তৈরি করতে পারে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি মানব সক্ষমতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। এই পথে এগিয়ে চলার জন্য প্রয়োজন কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিক মানদণ্ড, যাতে মস্তিষ্কের এই ডিজিটাল দুয়ার মানবজাতির জন্য সত্যিকার অর্থেই কল্যাণকর হয় এবং নতুন এক মানবিক ডিজিটাল যুগের সূচনা হয়।





