বিশ্বের কোন দেশে এনইআইআর-এর মতো প্রযুক্তি লুকিয়ে আছে?
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ (তুষার): অবৈধ মোবাইল ফোন শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ এখন বিশ্বের বহু দেশের টেলিকম নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রযুক্তির নাম ভিন্ন হলেও মূল উদ্দেশ্য একই তা হলো- অবৈধ, ক্লোন বা চুরি হওয়া মোবাইল ফোন শনাক্ত করা, নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা বাড়ানো এবং মোবাইল বাজারকে স্বচ্ছ রাখা। বাংলাদেশে চালু হতে যাচ্ছে ‘ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার’ (এনইআইআর) যা এর পুরো ধারণাটিই আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ‘সেন্ট্রাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার’ (সিইআইআর)-এর আধুনিক সংস্করণ।
বিশ্বব্যাপী কেন এই প্রবণতা বাড়ছে
বিশ্বের অনেক দেশেই আইএমইআই রেজিস্ট্রি নীতির পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য হলো অবৈধভাবে আমদানি, নকল ও চুরি হওয়া ফোন নিয়ন্ত্রণ, চুরি হওয়া ফোন শনাক্ত করা এবং ব্লক করা। অবৈধ (স্মাগলিং) মোবাইল ফোন আমদানি রোধ করার জন্য বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ আইএমইআই রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক করেছে, যাতে তারা কর ও শুল্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অপারেটররা নকল বা ক্লোন আইএমইআই- ডিভাইসগুলোর কারণে নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারে; রেজিস্ট্রি সিস্টেম সেই ঝুঁকি কমায়। কিছু দেশ একে অপরের সঙ্গে আইএমইআই ব্লকলিস্ট শেয়ার করে বা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সিস্টেম তৈরি করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কী প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে
ভারত: ২০২৩ সাল থেকে পুরো দেশে চালু করেছে সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর)। এর ফলে অবৈধভাবে আমদানি করা মেবাইল ফোন, চুরি বা হারানো মোবাইল ফোন ব্লক করা যায় তাৎক্ষণিকভাবে। নকল আইএমইআই যুক্ত মোবাইল ফোন সরাসরি নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। মোবাইল বাজারে প্রতারণা, চুরি ও গ্রে–মার্কেট নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখছে। ভারতের সিইআইআর বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ সিস্টেম।
পাকিস্তান: ২০১৯ সাল থেকে পিটিএ- এর অধীনে চালু করেছে ডিভাইস আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ব্লকিং সিস্টেম (ডিআইআরবিএস)। এই সিস্টেম নকল ও ক্লোন আইএমইআর শনাক্তে অত্যন্ত কার্যকর। অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে রেজিস্ট্রেশন পায় না। এর ফলে মোবাইল আমদানি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। ডিআইআরবিএস আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একটি মডেল, যা বাংলাদেশে চালু হতে যাওয়া এনইআইআর- এর মতোই কাজ করে।
নেপাল: টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করছে মোবাইল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এমডিএমএস) । তাদের দেশে প্রবেশ করা প্রতিটি মোবাইল ফোন সহ ডিভাইস রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। এর ফলে নকল ও অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল বাজার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীরা চুরি হওয়া ফোন ব্লক করার সুযোগ পাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা: সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর) সিস্টেম ভিত্তিক নিবন্ধন চালু করেছে কয়েক বছর আগে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো অবৈধভাবে আমদানি করা মেবাইল ফোন এবং গ্রে মার্কেট কমানো, অপারেটরদের নেটওয়ার্ক সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং চুরি হওয়া ফোন দ্রুত নিষ্ক্রিয় করা।
ইন্দোনেশিয়া: মোবাইল ফোন আইএমইআই রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক। সরকার অবৈধ বা ‘হোলি-মাউথ’ (black-market) ফোন এবং নকল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে এই নিয়ম চালু করেছে।
তুরস্ক: দেশটি আইএমইআই রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম বিশ্বের অন্যতম কঠোর রেজিস্ট্রেশন নীতি পরিচালনা করে। বিদেশ থেকে আনা ফোন নিবন্ধন না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্লক করে দেয়া হয়। কর ফাঁকি, অবৈধভাবে আমদানি ও প্রতারণা কমাতে বড় ভূমিকা রাখছে এই সিস্টেম।
কলম্বিয়া: কমিউনিকেশন রেগুলেশন কমশিন (সিআরসি) এবং আইসিটি মন্ত্রনালয় আইএমইআই-ভিত্তিক সিস্টেম চালু করেছে, যা চুরি করা ফোন সনাক্ত ও ব্লক করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়া ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে এবং এটি মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে ডেটা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড: আইএমইআই ডেটাবেজ বাধ্যতামূলক হিসাবে বাধ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ সেই দেশগুলোর ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি আছে যেখানে মোবাইল অপারেটররা অবৈধ বা নকল মোবাইল ফোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ইরান, নাইজেরিয়া, ইউক্রেন, লেবানন: আইএমইআই রেজিস্ট্রি বা নিবন্ধন সিস্টেম রয়েছে। বিশেষ করে আইএমইআই ব্লকলিস্ট অথবা ‘positive list’ (whitelist) তৈরি করে নেটওয়ার্ক অপারেটররা অবৈধ মোবাইল ফোন বা চুরি করা ডিভাইস নিষিদ্ধ করতে পারে। এই ধরনের সিস্টেম ব্যবহার করে তারা নকল ডিভাইস, চুরি হওয়া ফোন এবং অবৈধ আমদানিকারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
আফ্রিকার বহু দেশে একই ধরণের সিস্টেম: বহু আফ্রিকান দেশ ইতোমধ্যেই সিইআইআর বা তার উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করছে। যেমন- নাইজেরিয়ায় ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টি রেজিস্ট্রার (ইআইআর);
কেনিয়ায় সিইআইআর ভিত্তিক অবৈধ ফোন নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম; তানজানিয়া, ঘানা, উগান্ডা নকল বা অবৈধ ফোন শনাক্তে সিইআইআর কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এই সিস্টেমগুলো ব্যবহারের ফলে অবৈধ ফোন শনাক্তের পাশাপাশি অপরাধ তদন্তেও সহায়তা পাওয়া যায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইআইআর ভিত্তিক সিস্টেম: ইউরোপের প্রায় সব দেশে অপারেটর–স্তরে ইআইআর ব্যবহার হয়। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ইত্যাদি দেশে ইআইআর বাধ্যতামূলক। ফোন চুরি হলে অপারেটর তাৎক্ষণিকভাবে ব্লক করে। গ্রাহক সুরক্ষা ও সাইবার সেফটির মূল অংশ হিসেবে বিবেচিত।
মেক্সিকো ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো: মেক্সিকো, চিলি, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা অবৈধ/চুরি হওয়া মোবাইল চিহ্নিত ও ব্লক করতে ইআইআর নির্ভর ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সরকার ও অপারেটর একসঙ্গে ডিভাইস ডাটাবেস পরিচালনা করে।
বাংলাদেশে এইআইআর চালুর গুরুত্ব
বাংলাদেশে নকল, ক্লোন, গ্রে–মার্কেট এবং অবৈধভাবে আমদানি করা ফোন বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই সমস্যা তৈরি করে আসছে। এইআইআর চালু করা হলে নেটওয়ার্ক আরও সুরক্ষিত হবে, চুরি বা হারানো ফোন ব্লক করা যাবে, টেলিকম খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে, রাজস্ব ফাঁকি কমবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ সহজ হবে।
বাংলাদেশ কার্যত সেইসব দেশের সারিতে যুক্ত হলো, যারা আধুনিক মোবাইল সুরক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুরো টেলিকম ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখন অবৈধ মোবাইল দমন এবং গ্রাহকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিইআইআর বা এনইআইআর ধারার প্রযুক্তিকে বাধ্যতামূলক করেছে। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা সবখানেই এই প্রযুক্তি মোবাইল চুরি, প্রতারণা, অপরাধ ও কর ফাঁকি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের এনইআইআর সেই বৈশ্বিক মানের প্রযুক্তিরই ঘরোয়া সংস্করণ, যা দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন গতি আনবে।





