বিশ্বজুড়ে আইএমইআই রেজিস্ট্রি ট্রেন্ড: বাংলাদেশের এনইআইআর কোথায় দাঁড়িয়ে
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ন্যাশনাল ইক্যুপইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (NEIR) বা আইএমইআই (IMEI) ভিত্তিক নিবন্ধন ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী মোবাইল নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা, রাজস্ব সুরক্ষা এবং অবৈধ মোবাইল ফোন মোকাবিলায় এক প্রমাণিত কৌশল। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য হলো চোরাচালান ও নকল মোবাইল ফোন এবং এর ফলে সৃষ্ট কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করা। আইএমইআই-ভিত্তিক এই ইক্যুইপমেন্ট রেজিস্ট্রি ব্যবস্থার ধারণা ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকে কার্যকর হতে শুরু করে।
এনইআইআর: বাংলাদেশের কাঠামো
বাংলাদেশের এই সিস্টেমটি ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার বা সংক্ষেপে এনইআইআর নামে পরিচিত। এর প্রধান কার্য পরিধি হলো শুধুমাত্র বৈধপথে আমদানি হওয়া, শুল্ক পরিশোধ করা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডিভাইসগুলোকে মোবাইল নেটওয়ার্কে সক্রিয় হওয়ার অনুমতি দেয়া, যা হোয়াইট লিস্টিং নামে পরিচিত। পাশাপাশি, চুরি যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া ডিভাইসগুলোকে নেটওয়ার্কে সংযোগ দেয়া থেকে স্থায়ীভাবে বিরত রাখা হয়, যা ব্ল্যাক লিস্টিং।
এই ব্যবস্থা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সক্রিয় ডিভাইসের পরিচয় নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই ব্যবস্থাকে কাস্টমস ডেটাবেসের সঙ্গে সংযুক্ত করে চোরাচালান রোধ ও শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব সুরক্ষা দেয়। গ্রাহক সুরক্ষার জন্য আইএমইআই যাচাই এবং চুরি যাওয়া ডিভাইস ব্লক করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের এনইআইআর ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী ব্যবস্থা সিইআইআর, ডিআইআরবিএস, ইউজেডআইএমইআই-এর সমান্তরালে অবস্থান করছে
বৈশ্বিক ডিভাইস রেজিস্ট্রি ও তাদের পদ্ধতি
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত প্রধান কয়েকটি সিস্টেম, তাদের অর্থনৈতিক অবদান ও পদ্ধতির বিবরণ নিচে দেয়া হলো।
ক) ভারত: সিইআইআর ও ডিআইআরবিএস
ভারত সরকার কর্তৃক পরিচালিত কেন্দ্রীয় ডেটাবেসের নাম হলো সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর)। এটি ডিভাইস আইডেন্টিফিকেশন, রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ব্লকিং সিস্টেম (ডিআইআরবিএস) নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত। সিইআইআর বর্তমানে ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি সক্রিয় ডিভাইস রেকর্ড ট্র্যাক করতে সরকারি বিভাগকে সহায়তা করে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা: সিইআইআর/ডিআইআরবিএস-এর কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে ভারত সরকার অবৈধ আমদানি এবং শুল্ক ফাঁকির কারণে বার্ষিক যে আনুমানিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছিল, তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ট্রাই এবং ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় এই প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করে।
পদ্ধতি ও গ্রাহক সুরক্ষা: ‘সঞ্চার সাথী’ পোর্টালের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সহজেই আইএমইআই স্ট্যাটাস যাচাই করতে পারে।
খ) পাকিস্তান: ডিআরআইবিএস
পাকিস্তানের এই সিস্টেমটির নাম হলো ডিভাইস আইডেন্টিফিকেশন, রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ব্লকিং সিস্টেম (ডিআরআইবিএস)। এর কার্য পরিধি হলো নকল ও অবৈধ ডিভাইসের ব্যবহার রোধ এবং স্থানীয় মোবাইল উৎপাদন শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা: ডিআরআইবিএস চালুর পর পাকিস্তানে মোবাইল শিল্পের রাজস্ব আদায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ বাজারের ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ অবৈধ ডিভাইস বৈধ চ্যানেলে ফিরে এসেছে। পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি (পিটিএ) এই রাজস্ব প্রবাহ নিশ্চিত করে।
পদ্ধতি: এই ব্যবস্থায় ডিভাইস নিবন্ধনের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় এবং কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়।
গ) তুরস্ক: ইক্যুইপমেন্ট রেজিস্ট্রি (IMEI Kayıt)
তুরস্কের এই ব্যবস্থাটি ইক্যুইপমেন্ট রেজিস্ট্রেশন (IMEI Kayıt) নামে পরিচিত। এর কার্য পরিধি হলো বিদেশ থেকে আনা বা গ্রে মার্কেট থেকে আসা ফোনের নিয়ন্ত্রণ।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা: তুরস্ক কঠোর হোয়াইট লিস্টিং নীতি অনুসরণ করে। বিদেশ থেকে কেনা ফোন ১২০ দিনের মধ্যে স্থানীয়ভাবে ট্যাক্স প্রদান ও নিবন্ধন করতে হয়। এই বাধ্যতামূলক নিবন্ধন ফি এবং ট্যাক্স তুরস্কের সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য স্থায়ী রাজস্ব প্রবাহ তৈরি করেছে।
নাইজেরিয়ার এই সিস্টেমটিও বাংলাদেশের মতোই এনইআইআর নামে পরিচিত
ঘ) উজবেকিস্তান: ইউজেডআইএমইআই
উজবেকিস্তানের এই সিস্টেমটির নাম হলো ইউজেডআইএমইআই সিস্টেম (UZIMEI System)। এর কার্য পরিধি হলো কঠোর রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা: এই ব্যবস্থা কাস্টমসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। আইএমইআই নিবন্ধন এবং শুল্ক প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় এটি মানবীয় ত্রুটি এবং দুর্নীতি কমায়, যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে আরও স্বচ্ছ করে তুলেছে।
ঙ) মেক্সিকো: আইএমইআই রেজিস্ট্রি
মেক্সিকোর এই সিস্টেমটির নাম হলো আইএমইআই রেজিস্ট্রি। এর প্রধান কার্য পরিধি হলো চুরি যাওয়া মোবাইল ফোনগুলোর ব্যবহার রোধ করা।
অর্থনৈতিক প্রভাব: মেক্সিকোর মতো দেশে যেখানে মোবাইল চুরি একটি বড় সমস্যা, সেখানে ব্ল্যাকলিস্টিংয়ের মাধ্যমে চুরি হওয়া ডিভাইসের বাজার মূল্য শূন্যে নামিয়ে আনা হয়, যা চুরিজনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং বীমা দাবি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
চ) নাইজেরিয়া: ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর)
নাইজেরিয়ার এই সিস্টেমটিও বাংলাদেশের মতোই ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) নামে পরিচিত।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা: এই পদ্ধতি চালুর আগে নাইজেরিয়ার বাজারে মিলিয়ন মিলিয়ন অনিবন্ধিত ও নিম্নমানের ডিভাইস অনুপ্রবেশ করত। এই এনইআইআর ব্যবস্থা কঠোরভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে নাইজেরিয়ান কমিউনিকেশনস কমিশন (এনসিসি) চোরাচালান ঠেকিয়ে বৈধ বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং স্থানীয় অর্থনীতির সুরক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
ছ) চিলি: আইএমইআই হোয়াইট লিস্ট
চিলির এই সিস্টেমটির নাম হলো আইএমইআই হোয়াইট লিস্ট। এর কার্য পরিধি হলো নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ।
পদ্ধতিগত সুরক্ষা: শুধুমাত্র অনুমোদিত ডিভাইসগুলোকে নেটওয়ার্কে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়। এই কঠোর হোয়াইট লিস্টিং পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে কোনও অবৈধ ডিভাইস কখনোই নেটওয়ার্কের সুবিধা নিতে পারবে না, যা রাজস্ব সুরক্ষা দেয়।
গ্রাহক সুরক্ষার জন্য আইএমইআই যাচাই এবং চুরি যাওয়া ডিভাইস ব্লক করার সুযোগ রয়েছে
পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ
বিশ্বজুড়ে এই দেশগুলো মূলত দুটি প্রধান কৌশলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহক উভয়কে সুরক্ষা দেয়-
ক) প্রতিষ্ঠান এবং রাজস্ব সুরক্ষা:
তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং ভারত এই দেশগুলো প্রমাণ করেছে যে আইএমইআই রেজিস্ট্রির সঙ্গে কাস্টমসের স্বয়ংক্রিয় সংযোগ স্থাপন করে শুল্ক ফাঁকি দেয়া ডিভাইসগুলোকে নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। এই প্রক্রিয়া সরকারের রাজস্ব আদায়ে শত শত কোটি টাকা যুক্ত করে এবং স্থানীয় মোবাইল উৎপাদন শিল্পকে রক্ষা করে।
খ) গ্রাহক সুরক্ষা:
ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো গ্রাহকদের ‘পাবলিক ভেরিফিকেশন পোর্টাল’ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, যার মাধ্যমে তারা নকল বা চুরি হওয়া ডিভাইস কেনা থেকে বিরত থাকেন। এটি এক ধরনের ভোক্তা আস্থা সূচক হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি, নকল আইএমইআই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সিইআইআর/এনইআইআর সিস্টেমগুলো একই আইএমইআইয়ের অধীনে একাধিক ডিভাইস সক্রিয় দেখলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযোগ বন্ধ করে দেয়। যেহেতু শুধু বৈধ ডিভাইসগুলোই নেটওয়ার্কে কাজ করে, তাই গ্রাহকরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানসম্পন্ন এবং ওয়ারেন্টিযুক্ত পণ্য কিনতে উৎসাহিত হন।
আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা
এই ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশনগুলোর ভূমিকা অপরিহার্য। গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ) বিশ্বব্যাপী আইএমইআই ডেটাবেসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক এবং মান নির্ধারণকারী। স্থানীয় সিস্টেমগুলো চুরি যাওয়া ডিভাইসের আন্তর্জাতিক ব্ল্যাকলিস্টিং এর জন্য সরাসরি জিএসএমএ-এর তথ্যের ওপর নির্ভর করে।
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এই সংস্থা সদস্য দেশগুলোকে টেলিযোগাযোগের মান এবং নীতি নির্ধারণে সহায়তা করে। মোবাইল প্রস্তুতকারক সমিতি এবং মোবাইল অপারেটরদের সংগঠনগুলো এই সিস্টেমে আইএমইআই ডেটা সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে নীতিগত সমন্বয় রক্ষা করে।
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের এনইআইআর ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী ব্যবস্থার (সিইআইআর, ডিআইআরবিএস, ইউজেডআইএমইআই) সমান্তরালে অবস্থান করছে। নাম ভিন্ন হলেও, অবৈধ ডিভাইস ঠেকানো, রাজস্ব বৃদ্ধি এবং গ্রাহকের আস্থা অর্জন এই তিন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক কৌশল একই।





