প্রতিবেদন

বিমানবন্দরের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: ধ্বংস হওয়া স্বপ্ন, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): সাম্প্রতিককালে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (HSIA) এর আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটি শুধুমাত্র একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নয়, এটি দেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লজিস্টিকস শৃঙ্খলে এক বিশাল আঘাত। এখানে ছোট-বড় হাজারও উদ্যোক্তার বহু কোটি টাকার আমদানি পণ্য, গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল এবং জরুরী চিকিৎসা সামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

এই বিপর্যয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে নির্ভরযোগ্যতার ওপর গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আপনার মতো সচেতন নাগরিকদের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার মানবিক উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়, তবে এই দুর্যোগের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বুঝতে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ক্ষয়ক্ষতি, প্রভাব ও করনীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত জানা অপরিহার্য।

অগ্নিকাণ্ডের বিস্তারিত ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যাগত চিত্র
অগ্নিকাণ্ডটি ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ শনিবার দুপুর আনুমানিক ২:৩০ মিনিটের দিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্স ভবনের (আট নম্বর গেটের পাশে) ‘স্কাই ক্যাপিটাল ওয়্যারহাউস’ সহ অন্যান্য অংশে ঘটে।

জাতীয় নিরাপত্তা প্রেক্ষাপট: উল্লেখ্য, গত কয়েকদিনের ব্যবধানে এটি চট্টগ্রাম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (CEPZ) এবং ঢাকার রাসায়নিক গুদাম ও পোশাক কারখানায় (যেখানে ১৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল) অগ্নিকাণ্ডের মতো পরপর ঘটে যাওয়া বড় দুর্ঘটনার একটি। এই ধারাবাহিক বিপর্যয় প্রমাণ করে যে, কেবল বিমানবন্দর নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় গুরুতর ঘাটতি রয়েছে।

দমকল ও উদ্ধারকারী তৎপরতা: আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে মোট ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট প্রায় সাড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ধরে কাজ করে। আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরাও সহযোগিতা করেন। এই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবটের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও করা হয়।

আহত ও বিঘ্ন: আগুন নেভাতে গিয়ে আনসার বাহিনীর অন্তত ২৫ জন সদস্যসহ মোট ৩৫ জন আহত হন। অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিমানবন্দরে প্রায় ৭ ঘণ্টা উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ ছিল, ফলে অন্তত নয়টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চট্টগ্রাম ও সিলেটে ভিন্ন পথে চালিত করতে হয়।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ (প্রাথমিক অনুমান): অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ব্যবসায়িক সংস্থা ও আমদানিকারকদের প্রাথমিক আশঙ্কা অনুযায়ী, আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ১ বিলিয়ন ডলার (১০০ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঢাকা কাস্টমস হাউস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে এক হাজার কোটি টাকাও হতে পারে।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ই-কমার্স ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের ক্ষতি
বিমানবন্দরের আগুনের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে ই-কমার্স এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (SME) খাতের হাজারও ব্যবসায়ী।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মূলধন বিলুপ্তি: ই-ক্যাবের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৫ লক্ষাধিক ই-কমার্স ও এফ-কমার্স উদ্যোক্তা সক্রিয় আছেন, যার ৯৫ শতাংশই ছোট ব্যবসায়ী উদ্যোগ। একজন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৪০ হাজার ডলার (প্রায় ৪৪ লক্ষ টাকা) মূল্যের পণ্য সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা প্রমাণ করে যে, অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সীমিত মূলধন এই বিপর্যয়ে বিলুপ্তির মুখে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের ক্ষতি: আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের একটি অংশ আন্তর্জাতিক কুরিয়ার এবং এক্সপ্রেস কার্গো সার্ভিসগুলো (যেমন- DHL, FedEx) ব্যবহার করত। ফলে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উচ্চমূল্যের ব্যক্তিগত প্যাকেজ এবং জরুরি নথি বা নমুনা সামগ্রীও এই আগুনে পুড়ে গেছে।

লজিস্টিকস ও আস্থায় সংকট: সময়মতো ডেলিভারি ই-কমার্স ব্যবসার ভিত্তি। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে দীর্ঘসূত্রিতা ও পণ্য ঘাটতির কারণে গ্রাহকদের কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অসম্ভব হবে, যা এই খাতের আস্থা সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরের উপর ক্ষয়ক্ষতি ও প্রভাব
উৎপাদন ও রপ্তানি আয় ক্ষতি: আরএমজি সেক্টরের জরুরি কাঁচামাল ও ক্রেতাদের নমুনা পুড়ে যাওয়ায় কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। বিকেএমইএ-এর উদ্বেগ অনুযায়ী, সময়মতো সরবরাহ করতে না পারায় ক্রেতাদের দ্বারা অর্ডার বাতিল এবং মূল্যছাড় চাপিয়ে দেয়ার কারণে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।

বৈশ্বিক আস্থায় ধাক্কা: ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মতে, এই ধরনের ঘটনা পণ্য পরিবহনে অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ ও ব্যবসায়ীদের করণীয়
এই কঠিন সময়ে দ্রুত পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল গ্রহণ অপরিহার্য। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠে আবার সঠিক জায়গায় ফেরত আসতে হলে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ-
সরকারি সহায়তা ও বীমা আশ্বাস: অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যগুলো যেহেতু সাধারণত মেরিন বীমা দ্বারা সুরক্ষিত থাকে, তাই আমদানিকারকরা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া দ্রুত করার পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকা কাস্টম হাউসে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নিয়েছে।

নিরাপত্তা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জোরদার: এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ও আধুনিক ফায়ার ফাইটিং প্রযুক্তি নিশ্চিত করা উচিত। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য কম প্রিমিয়ামে বিশেষ বীমা প্যাকেজ চালু করা যেতে পারে এবং শুধুমাত্র বিমানবন্দর কার্গো নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প লজিস্টিক চ্যানেল শক্তিশালী করার উপর জোর দেয়া প্রয়োজন।

মানবিক ও ব্যবসায়িক সহযোগিতা জরুরি (আপনার আহ্বান):
দুর্যোগ আমরা কখনও শূন্যে হয়তো নামিয়ে আনতে পারব না, কিন্তু ইনস্যুরেন্স সেক্টরটা অনেক স্ট্রং হওয়া উচিত আমাদের দেশে। আমাদের যেসকল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পাশে যার পক্ষ থেকে যেভাবে সম্ভব পাশে থাকুন। ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে দ্রুত উঠে দাঁড়ান, তার জন্য-

গ্রাহক ও রিটেইলারের ভূমিকা: গ্রাহক হলে অন্তত তাদের পেজে নক দিয়ে পাশে থাকার বার্তা দেয়া প্রয়োজন। রিটেইলাররা সুযোগ থাকলে তাদের কিছু এডভান্স পেমেন্ট করতে পারেন।

ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সমর্থন: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ক্ষতিগ্রস্ত সেলারদের পণ্য আগামী ১ মাস টপে রেখে এবং কোনো কমিশন না নেয়া- এই ধরনের উদারতা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে সবচেয়ে বড় সহায়তা দেবে।

বিজনেস দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। আল্লাহ যেন এমন দুর্ঘটনায় কোনও পরিবারকে ধ্বংস না করেন। এই সম্মিলিত মানবিক ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমেই ক্ষতিগ্রস্তরা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও সক্ষমতা ফিরে পাবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লজিস্টিকস শৃঙ্খলে এক তীব্র ও সুদূরপ্রসারী ক্ষত তৈরি করেছে। প্রাথমিকভাবে ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, তা কেবল একটি বিশাল আর্থিক ক্ষতির হিসাব নয়- এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা, হাজারও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার পুঁজি এবং দেশের বৈশ্বিক বাণিজ্যিক আস্থার ওপর আঘাত। এটি আবারও প্রমাণ করলো যে, দেশের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কতটা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে যাদের পুঁজি ছিল সীমিত, তারা দ্রুত এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে মূলত সরকারের ত্বরিত, স্বচ্ছ নীতিগত সহায়তা এবং দেশের ব্যবসায়িক সমাজের ঐকান্তিক মানবিক ভূমিকার ওপর। বীমা প্রক্রিয়া যেন দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে না যায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।

একইসঙ্গে, কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়াকে আধুনিক ও নিরাপদ করে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই বিপুল ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে একটি সুনির্দিষ্ট সময়রেখা দেওয়া সম্ভব না হলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে, লজিস্টিকস ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে- কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা, দেশের শিল্প ও নিরাপত্তা মান উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি ব্যবসায়ী সমাজের সংহতি। বিপর্যয় সাময়িক হলেও এর শিক্ষা সুদূরপ্রসারী হওয়া উচিত। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা এবং ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। এইভাবেই ডিজিটাল রুপান্তর-এর স্বপ্নকে সুরক্ষিত রেখে আমরা আবার সঠিক স্থানে ফিরে যেতে পারব। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *