বিটিআরসি সংস্কারের প্রস্তাব বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের
ক.বি.ডেস্ক: ইন্টারনেট মৌলিক মানবাধিকার ঘোষণা করা সহ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি তথা বিটিআরসি, বিটিসিএল, টেলিটক, ডট এবং আইসিটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহ সংস্কারের জন্য সরকার কমিশন গঠন করেনি। সরকার কমিশন গঠন না করলেও অন্ততপক্ষে বিটিআরসির সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। সে প্রেক্ষিতে বিটিআরসি সংস্কারে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।
গতকাল রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিটিআরসি ভবনে আয়োজিত এক বৈঠকে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদুল হক বারির নিকট সংস্কার প্রস্তাব তুলে দেয় বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে চায় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলে ছিলেন এডভোকেট মনিরুজ্জামান শাশ্বত মনির, প্রকৌশলী আবু সালেহ ও তথ্য দপ্তর সম্পাদক শেখ ফরিদ।
বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান এমদাদুল হক বারি বলেন, “কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে, সেই সঙ্গে কোয়ালিটির সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কেন মানহীন সেবা দেয়া হচ্ছে সেটি খুঁজে বের করে কমিশনকে জানাতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং গ্রাহকের সঠিক তথ্য কমিশনকে জানিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। এর জন্য গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনকে সহযোগিতা করতে হবে।”
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা দীর্ঘ ১০ বছর যাবত কমিশনকে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে সহযোগিতা করে আসছি। আমরা চাই কমিশন আইন সংস্কার করে কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সার্বিক সহযোগিতা করতে। গ্রাহকদের অধিকার রক্ষায় কমিশনকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শতভাগ মানুষের চাহিদা মেয়াদ সহ ইন্টারনেট ডাটা এ ব্যাপারে কমিশনকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই।”
বিটিআরসি সংস্কারে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাবসমূহ হলো……
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন
বাংলাদেশ টেলিযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (সংশোধনী ২০১০) সময় উপযোগী করে তুলতে ও বেশ কিছু অসামাঞ্জস্য থাকায় এই আইন সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা একান্ত আবশ্যক। এই আইনটি করার উদ্দেশ্য ছিল টেলিযোগাযোগ সেবার মান উন্নয়ন ও দক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম কমিশন প্রতিষ্ঠা করা।
কমিশন গঠনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা
কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অযোগ্য ধারা ১০ এ একই সঙ্গে কমিশন গঠন ৭ ধারায় বলা আছে বাংলাদেশের নাগরিক নয় এমন ব্যক্তিকে কোনোভাবেই কমিশনের নিয়োগ করা যাইবে না। একই সঙ্গে কমিশন গঠন ৭ ধারার (৩)এ বলা হয়েছে কমিশনের পদ শূন্যতা বা কমিশন গঠনে ত্রুটি থাকার কারণে কমিশনের কোন কার্য বা কার্যধারা অবৈধ প্রতিপন্ন হইবে না। অর্থাৎ আইনের এই ধারা দুটি সম্পূর্ণভাবেই সাংঘর্ষিক এবং গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তাই ধারা দুটি পরিবর্তন অর্থাৎ বাতিল করা অতি আবশ্যক।
সকল নিয়ন্ত্রণ বিটিআরসি কাছে থাকা অতি আবশ্যক
ইন্টারনেটের সকল মাধ্যম, অ্যাপ, ক্লাউড কম্পিউটিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওটিটি প্লাটফর্ম, ইন্টারনেট ভিত্তিক টিভি, ডোমেইন, সহ-সকল মাধ্যম বিটিআরসি’র নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে এর একমাত্র নিয়ন্ত্রক কমিশন হবে বিটিআরসি। একই সঙ্গে এনটিএমসিকে টেলিযোগাযোগ আইন অনুসরণ করে এবং বিটিআরসি’র পূর্বানুমোদন নিয়ে টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম/মনিটরিং পরিচালনা করতে হবে।
ইন্টারনেট বন্ধ ও সচল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা
ইন্টারনেট কখন বন্ধ থাকবে কখন সচল থাকবে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে বিটিআরসি’র কাছে। ভবিষ্যতে কখনোই কোন পরিস্থিতিতেই যাতে ইন্টারনেট বন্ধ না থাকে এ ব্যাপারে বিটিআরসিকে স্পষ্টভাবে আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। ইন্টারনেটকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে কমিশন হইতে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।
ইন্টারনেট ও ভয়েজ কলের ট্যারিফ নির্ধারণ
মোবাইল অপারেটরগণ মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাব কমিশনে উপস্থাপন করবে। কমিশন তার ভিত্তিতে একটি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে পর্যালোচনা করবে। পরবর্তীতে গ্রাহক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সকল স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে কমিশন এই মূল্য সম্পর্কে একটি গণশুনানি আয়োজন করবে। পরবর্তীতে সকলের মতামত সাপেক্ষে একটি যুক্তিক মূল্য নির্ধারণ করবে কমিশন।
কমিশনে নিয়োগ পদ্ধতি
দলীয় বিবেচনা বা ব্যক্তির সুপারিশে এমনকি দুর্নীতির মাধ্যমে কোনভাবেই নিয়োগ প্রদান করা যাইবে না এমনকি পদোন্নতিও দেয়া যাইবে না। বিগত কমিশনে দলীয় বিবেচনায় ও অনৈতিক অর্থের বিনিময়ে যে সকল নিয়োগ দেয়া হয়েছে, এ নিয়ে ইতিমধ্যে দেশের বেশ কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে সে বিষয়ে নতুন করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে কমিশনকে।
সেবার মূল্য কমানো প্রসঙ্গে
মধ্যস্বত্তভূমি আইসিএক্স, আইজিডব্লিউ, ভ্যালু এডেড সার্ভিস, তুলে দিলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ মূল্য কমানো সম্ভব। সেই সঙ্গে আইআইজি ও সাবমেরিন ক্যাবল সক্ষমতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে লাইসেন্স উন্মুক্ত করে দিলে আরও ১৫% মূল্য কমানো সম্ভব। একইভাবে পদ্মা সেতুর সার চার্জ এক শতাংশ তুলে দিলে আরও ১ শতাংশ মূল্য কমানো সম্ভব। একইভাবে অতিরিক্ত সিম ও কর সেবায় মূসক ও ভ্যাট কমানো গেলে এই মুহূর্তে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মূল্য কমানো সম্ভব।
টাওয়ারকো
২০১৮ সালে দেশের চারটি টাওয়ারকো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করা হলেও কেবলমাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান সক্ষমতা দেখিয়েছে। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে ফ্রন্টটিয়ার ইতিমধ্যে অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই অযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কমিশনকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে একই সঙ্গে এক হাতের লাইসেন্স অবমুক্ত করতে হবে প্রয়োজন হলে যোগ্য, সক্ষম প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
টাওয়ার কোয়ালিটি
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে টাওয়ারগুলোর গুনগত মান কি হবে এবং পর্যবেক্ষণ কিভাবে করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা না থাকায় দেশে মানহীন যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি ও মাইক্রোওয়েভ দিয়ে টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কমিশনকে টাওয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইন জারি করতে হবে।
ওভারহেড ফাইবার ক্যাবল
দেশের প্রায় ৬৫% ক্যাবল এখনো ওভারহেড রয়েছে ফলে ঝড় বৃষ্টিতেই এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে শতভাগ ব্রডব্যান্ড ওভারহেড ক্যাবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে যা সম্পূর্ণভাবে নিরবিচ্ছিন্ন সেবার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তি
গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গ্রাহক দ্রুত সমাধান পাচ্ছে না। অথচ ৫৯ ধারায় বলা আছে যে, অভিযোগ দায়েরের সাত দিনের মধ্যে গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে। এমনকি উপধারা (৬) এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ পালন করা না হলে কমিশন দ্বারা ৬৩ এর অধীনে বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন আদেশ জারি করিতে পারিবে। ধারা সমূহ পরিবর্তন করে জরিমানার পরিমাণ ও শাস্তি কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামে এনে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ গ্রাহককে প্রদানের জন্য আমরা সুপারিশ করছি।
গণশুনানি
বছরে একবার নয় গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতি সপ্তাহে একদিন গনশুনানি করতে হবে এবং ট্যারিফ ও স্টেক হোল্ডারদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গণশুনানি প্রয়োজন অনুসারে অনুষ্ঠিত হবে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল
সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ৬ মাস অন্তর অন্তর প্রকাশ করতে হবে। এমনকি গ্রাহক স্বার্থে জনসচেতনতা সৃষ্টি বা নেটওয়ার্ক নির্মাণ এমনকি বিভিন্ন দুর্যোগের সময় ব্যয় করতে হবে।
দুর্নীতিমুক্ত কমিশন
কমিশনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কমিশনকে স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণ এবং দলীয় মুক্ত করতে হবে। কমিশনের পিয়ন থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান পর্যন্ত প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রতি বছর সম্পদের হিসাব পর্যালোচনা করতে হবে।
গবেষণা ও গুণগত মান সম্পন্ন সেবা: টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি সেবা ও ইন্টারনেটে গবেষণা খাতে মনোযোগী হতে হবে। কমিশনকে গুণগত মান সম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এক দেশ এক রেট গাইডলাইন বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।