বাজেট ২০২৩: সফটওয়্যার শুল্ক ও ভ্যাট বিড়ম্বনা
দেশের সফটওয়্যার খাতে ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ কতখানি জরুরি ও তার লাভ ক্ষতি নিয়ে লিখেছেন ইকবাল আহমদ ফখরুল হাসান (রাসেল)
বাংলাদেশের সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট খাতের শুরু হয় ২০০০ সালের পর থেকে। যদিও এটির পূর্ণতা পাওয়া শুরু করে ২০০৭ এ বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়া এবং ২০০৯ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষনার পর থেকে। যদিও ২০১১/২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাত নিতান্তই ইনভেস্টমেন্টবিহীন একটি ছোট সেক্টর হিসেবে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে নাই। কিন্তু বিগত ১০ বছরে সফটওয়্যার খাত দুটো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো দেশীয় বাজারে সফটওয়্যার দিয়ে সক্ষমতা তৈরি এবং অন্যটি হলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন।
এসএমই খাতে এ দেশীয় সফ্টওয়ার পণ্য ও ভ্যাট আরোপের প্রভাব:
দেশীয় এসএমই খাতের বেশিরভাগ সফটওয়্যারই (পস, হিসাব সংরক্ষণ, ব্যবসা পরিচালনা) দেশে প্রস্তুত আছে এবং বাজার চাহিদার বেশিরভাগ দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো পূরণ করছে এবং যথেষ্ট কম মূল্যে। যদিও এই বাজারটিতে ভারত ও শ্রীলঙ্কার কিছু পণ্য যথারীতি বাজারের ভারসাম্য নষ্ট করে। কারণ, সফটওয়্যার এর মূল্য কম হওয়ার কারণে এগুলো প্রচলিত পদ্ধতিতে আমদানি হয়না এবং যার ফলে শুল্ক নিয়ে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়না তাদের লোকাল পার্টনারদেরকে।
এই খাতের দেশীয় সফটওয়্যার উৎপাদনের ওপর ভ্যাট আরোপ হলে এটি ভারত, শ্রীলঙ্কা ও অন্যদের হাতে যেতে খুব বেশি সময় লাগবেনা। দেশীয় ব্যবসায়ীদের অনীহা আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বলা প্রযোজ্য, এই খাতে তেমন কোনো কাস্টম সফটওয়্যার ব্যবহার হয়না কিন্তু অনলাইন থেকে কিছু সাস পণ্য ক্রেডিট কার্ড বা অন্য পদ্ধতিতে ক্রয় করে ব্যবহার হয়।
মাঝারি শিল্পে দেশীয় সফটওয়্যার ও ভ্যাট আরোপের প্রভাব:
বিগত ১০ বছরে মাঝারি শিল্পের সফটওয়্যারে বিদেশি পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো নিজেদের ইনভেস্টমেন্ট ও সক্ষমতা বাড়িয়ে বাজারের একাংশ দখলে নিয়েছে। সক্ষমতা ও স্তায়িত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো অনেক ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হয় এবং সেটি এখনও কাটিয়ে ওঠতে বেশ কয়েক বছর সময় প্রয়োজন।
মাত্র বাজার দেশীয় সফটওয়্যারে (ইআরপি, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও অন্যান্য) বিশ্বাস অর্জন করা শুরু করেছে। এই খাত এখনও অনিবন্ধিত বিদেশি (ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য ) কোম্পানি ও প্রচলিত পদ্ধতীর বাইরে গিয়ে আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকায় দেশীয় কোম্পানিগুলোকে যথেষ্ট কসরত করতে হয় সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। এই খাতে ভ্যাট আরোপ বিদেশি কোম্পানিগুলোর বাজার আগ্র্রাসনকে সাপোর্ট করার মতো হয়ে যাবে।
মাঝারি খাতে তৈরিকৃত সফটওয়্যার এর পাশাপাশি কাস্টম সফটওয়্যারের (ভ্যাট অনুযায়ী: সার্ভিস খাত) একটা বড় বাজার পরিলক্ষিত হয় যেটির বেশিরভাগ অংশই দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো দিয়ে আসছে। কাস্টমার চাহিদা মোতাবেক বাজেট কম থাকার কারণে বেশিরভাগ সময়ই সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোকে ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হতে হচ্ছে। বাজার সফটওয়্যার এ কাস্টম সফটওয়্যার কেনার দক্ষতা বাড়লে এই ক্ষতির পরিমাণ কমে যাবে। সর্বোপরি, মাঝারি শিল্পের কাস্টম সফটওয়্যার এ ভ্যাট আরোপ কাস্টমার ও সফটওয়্যার তৈরি প্রতিষ্ঠানকে নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করবে।
বৃহৎ শিল্পে দেশীয় সফটওয়্যার ও ভ্যাট এর প্রভাব:
বৃহৎ শিল্প ( ব্যাংক, টেলিকম, মেডিসিন, শিপিং অন্যান্য) খাতে দেশীয় সফটওয়্যারের পরিমাণ যথেষ্ট কম, কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের সক্ষমতা প্রমাণে ইনভেস্টমেন্ট ও সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং বেশ কিছু সফলতার গল্প তৈরি হয়ে আছে। যেটি প্রমাণ করে যে, দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দিলে তারা এই খাতে সফটওয়্যার দিয়ে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা বাঁচাতে পারবে। এই খাতের দেশীয় তৈরি পণ্য ( কোর ব্যাঙ্কিং বা টেলিকম সফটওয়্যার) বা কাস্টম সফটওয়্যারে ভ্যাট আরোপ যতার্থ অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এই খাতে সফটওয়্যার আমদানি কমানো গেলে অনাকাঙ্খিত মুদ্রা পাচার হওয়ার সম্ভাবনা ও কমে যাবে।
সরকারি পর্যায়ে দেশীয় সফটওয়্যার ও ভ্যাটের প্রভাব:
বিগত কয়েক বছরে দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সুনামের সঙ্গে ভূমিকা পালন করে আসছে। এই খাতে এর আগেও বিদেশি সফটওয়্যারের ব্যবহারের চাইতে দেশীয় সফটওয়্যারের সফলতা অনেক বেশি, কিন্তু বিদেশি সফটওয়্যার এর তুলনায় দেশীয় সফটওয়্যারের জন্য সরকারি বাজেট নিতান্তই কম। যার কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে অনেক ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হতে হয়। সঙ্গে এই খাতে ব্যাংক সাপোর্ট নিতান্তই দুর্বল। এই সব দিক বিবেচনা করে সরকারি পর্যায়ে দেশীয় সফটওয়্যার পন্য বা সেবা ভ্যাটমুক্ত ঘোষণা স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিদেশি সফটওয়্যার ও শুল্ক প্রভাব:
বিদেশি সফটওয়্যার পণ্যগুলো বিশেষত দুই ভাগে ভিবক্ত করা যায়।
এক: বাজারে নেই বা যেগুলো খুব সহজে তৈরি হবেনা বিভিন্ন কারণে যেমন পর্যাপ্ত ইনভেস্টমেন্ট অথবা টেকনোলজি সক্ষমতা অথবা সময়সাপেক্ষতার কারনে। এই ক্যাটাগরিতে প্রথমেই চলে আসে অপারেটিং সিস্টেম, যেটি গ্রাহক পর্যায়ে মূলত মাইক্রোসফট ভিত্তিক উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয়। অন্যদিকে সার্ভার সাইড এর জন্য মাইক্রোফটসহ ওপেনসোর্স ( যেই সফটওয়্যারগুলো মূলত বিনা খরচে বা ক্ষম খরচে ব্যবহার করা যায়) অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয়।
এই ক্যাটারির দ্বিতীয় সারিতে চলে আসে ডাটাবেস যেটিও আমাদের দেশে তৈরি হয়না কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ওপেন সোর্স ব্যবহার হয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কোম্পানিব্যতীত পেইড ডাটাবেস কম ব্যবহার হয়। তৃতীয় সারিতে সিকিউরিটি সফটওয়্যার, এম্বেডডেড সফটওয়্যার ও মেশিন ভিত্তিক সফটওয়্যারগুলো চলে আসে। এই জাতীয় সফটওয়্যারগুলোতে শুল্ক হারের পরিমাণ বাড়ানোতে (৫ থেকে ২৫% ) যা রাজস্ব আসবে তার চাইতে বেশি ক্ষতি হবে এই সফটওয়্যারগুলোর বিদেশি ভেন্ডরকর্তৃক বাজারমূল্য বাড়ানোর কারণে। যদিও এই ক্যাটাগরিগুলোতে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের চাইতে অনেক বেশি মূল্য নির্ধারণ করে রেখেছে।
দুই: যেই পণ্যগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয় কিন্তু ক্ষেত্র বেঁধে আনা প্রয়োজন বা ডিপ্লোমেটিক প্রয়োজনে উম্মুক্ত বাজার প্রদান করা। উম্মুক্ত বাজার নীতিতে আমাদের দেশে আইনগত প্রক্রিয়া যেকোন দেশ থেকে সফটওয়্যার আসতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন স্বনির্ভরতা অথবা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে দেশীয় পণ্য বা সেবাকে প্রাদান্য দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই পণ্যগুলার ভ্যাট ও শুল্ক করের পরিমাণ বাড়ানো ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি ধরে আরও সুবিন্যস্ত কোড প্রদান ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশের ভিশন পূরণে সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনেক জোরদার হবে।
একটি স্বল্প সময়ের সফলতা:
২০১৮ সালে এনবিআর কর্তৃক দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোকে ভ্যাট সফটওয়্যার বানানো ও বাজারজাত করণের নিবন্ধনের ফলে ভ্যাট রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ক্রমাগত অনলাইন হচ্ছে ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লেখক: ইকবাল আহমদ ফখরুল হাসান (রাসেল), প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী-ডিভাইন আইটি লিমিটেড