প্রতিবেদন

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার বর্তমান অবস্থা চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): জুলাই-আগস্ট এর ছাত্র ও জনতার বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চলমান সময়ে ই-কমার্স খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। আবার সরকারের চলমান নীতিসংস্কার কার্যক্রমেও ই-কমার্স খাত পুরো ব্যবসায়িক কার্যক্রমের একটা ছোট অংশ হলেও এই খাত প্রাধান্য পায়নি। দেশের কর্মসংস্থানের একটি অংশ ই-কমার্স খাত থেকে হয় যা পুরোপুরি উপেক্ষিত। এ খাতে সংস্কার এবং চলমান সংস্কার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উদ্যোক্তা, ই-ক্যাব সদস্য এবং এ খাতের সাড়ে তিন লাখেরও বেশি এসএমই উদ্যোক্তা এবং প্র্যায় ৩৫ লাখের মতো মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য ‘বাংলাদেশ ২.০’ ধারণায় বৈষম্যহীন ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে ই-কমার্স।

এ খাতের মাধ্যমে শহর-গ্রামের বৈষম্য কমিয়ে মেধাবী মানবসম্পদ ও তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব। এর যথেষ্ট প্রমাণও আমাদের হাতে রয়েছে। গ্রামে বসেও একজন তরুণ অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্সের মাধ্যমে সারা দেশের ভোক্তাদের কাছে তাঁর পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে কৃষিভিত্তিক ই-কমার্স উদ্যোগের সংখ্যা বাড়ছেই। এরই মধ্যে দেশীয় শিল্পের বিকাশ, উদ্যোক্তা তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এই খাত জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করছে। তবে ই-কমার্স খাতে উল্লেখযোগ্য কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ হলো ই-কমার্স এর জন্য ৩১তম বৃহত বাজার বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে। যার আর্থিক বাজার আনুমানিক প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ১২ কোটির মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারি আছে, যার মধ্যে ১০% ব্যবহারকারি মানে প্রায় ১ কোটি ব্যবহারকারি ই-কমার্স খাতে অর্ডার বা সেবা নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ই-কমার্সে অর্ডার করে থাকেন। দৈনিক প্রায় ৮ লাখের অধিক অর্ডার হয় এবং প্রতি অর্ডারে বাস্কেট সাইজ ১২৫০ থেকে ১৪৫০ টাকার মতো এবং দৈনিক ই-কমার্স এর লেনদেন হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো।

ই-ক্যাবের প্রায় ২৭০০ সদস্য সহ আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজ আছে যারা এফ কমার্স এবং ইনস্টাগ্রামে বিজনেস করে থাকেন। তিন লাখ ফেসবুক পেজে যারা বিজনেস করেন তাদের যার ৯৫% ই এসএমই বা ছোট উদ্যোক্তা, ৪% মাঝারি এবং ১% মার্কেটপ্লেস বা বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। দৈনিক প্রায় ২ লাখ ডলারের অধিক ফেসবুক অ্যাড বাবদ বাংলাদেশ থেকে নিয়ে থাকে।

ই-কমার্স খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় সম্প্রসারণের জন্য লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল বিপণন, ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট, ক্রাউড ফান্ডিং, ডেটা অ্যানালাইসিস সহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে ই–ক্যাব থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ই-কমার্স খাতের বিকাশের জন্য গ্রাহক ও উদ্যোক্তা উভয় পর্যায়েই ডিজিটাল স্বাক্ষরতা নিয়ে ব্যাপক কাজ করা যেতে পারে।

নীতিমালা সহায়তা এবং সরকারের করণীয়
ই-কমার্সই একমাত্র খাত যা ব্যবসায় ‘লেভেল প্লেয়িং অব ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন সহজলভ্য ও নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ রয়েছে…

১. ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের স্বার্থে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেটে নিশ্চিত করা। সেটি ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা দুই পক্ষের জন্যই নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেটকে এখন ‘পাবলিক ইউটিলিটি’ হিসেবে ঘোষণা করার সময় এসেছে, যেন এটি কখনো বন্ধ না হয়।

২. ডিজিটাল বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া। ট্রেড লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে সংযুক্ত করা। চলতি বছরের ট্রেড লাইসেন্স রিনিউর ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র রিনিউয়াল ফি নেয়া, উৎসে কর কর্তন বাদ দিয়ে।

৩. আগামী ১২ মাসের জন্য ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সংক্রান্ত এবং ব্যক্তিগত সমস্ত লোনের ইন্টারেস্ট মওকুফ করা অথবা একেবারে নমিনাল পর্যায়ে নিয়ে আসা। লোনের ইনস্টলমেন্টগুলোকে শুধুমাত্র মূল টাকাগুলো নিয়ে লোনকে সচল রাখা। এটিকে আমরা টুয়েলভ মানথ পেমেন্ট হলিডে হিসেবে আখ্যা দিতে পারি।

. ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জামানত বিহীন লোনের ব্যবস্থা করা। চিরাচরিত অফলাইন ব্যবসার মতো ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের অনেক সময় মেশিনারি, স্টাবলিশমেন্ট অনেক সময় থাকে না। এদের থাকে টেকনোলজি, গুড উইল, কাস্টমার ডেটা, কুরিয়ার ডেটা, ফেসবুক লাইক বা রিচ অথবা ওয়েবসাইটের গ্রহণযোগ্যতা। এগুলো বিবেচনা করেই লোনের ব্যবস্থা করা।

৫. চলতি অর্থ বছরের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক সমস্ত ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করা। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করা। ফেসবুক অ্যাড এর জন্য প্রদত্ত ১৫% ভ্যাট সহ। ফেসবুক অ্যাড এর ক্ষেত্রে অ্যাড লিমিট প্রত্যেকটি ই-কমার্স ব্যবসায়ীর জন্য বাৎসরিক সর্বনিম্ন ত্রিশ হাজার ডলার করে দেয়া উচিত।

. ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এসএমই উদ্যোক্তা হিসেবে সরাসরি আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত কার্ড, অনলাইন ট্রানজেকশন, এমএফএস এর ট্রানজেকশনগুলো আগামী ৬ থেকে এক বছর পর্যন্ত চার্জ মওকুফ করা। সেন্ট্রাল লজিস্টিক ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে সবার সেলস, ব্যবসায়ের গ্রোথ এবং কোম্পানি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার ব্যবস্থা করা।

৭. পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে ই-কমার্স গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেখানেই ই কমার্স ক্যাশলেস হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে হয়। কিন্তু ক্যাশলেস করার জন্য বাংলাদেশের এমএফএস কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই লেনদেন বেশি করাতে হলে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এমএফএস কোম্পানির সার্ভিস চার্জ ০.৫ টাকাতে নামিয়ে আনা এবং পেমেন্ট গেটওয়ের চার্জও ০.৬ টাকার মধ্যেই রাখার ব্যবস্থা করা। এটির সুফল কার্যত গ্রাহকরাই পাবে এবং মূল্য কমে যাবে।

৮. দেশীয় পণ্য দেশের বাইরে প্রচার-প্রসারের জন্য ক্রস বর্ডার ই-কমার্সকে উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত, সেক্ষেত্রে কুরিয়ার চার্জ ভ্যাট ট্যাক্স এর বিষয়গুলোকে ক্রস বর্ডারের জন্য শিথিল করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল পোস্টাল সার্ভিসকে আরও বেশি যুগোপযোগী এবং গ্রহণযোগ্য করে ক্রস বর্ডারকে উৎসাহিত করা উচিত।

. অনলাইননির্ভর ক্ষুদ্র ব্যবসা ই-কমার্স ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এ ধরনের ব্যবসগুলোকে সুদমুক্ত ও বিনা জামানতে ঋণ দিলে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং ব্যবসা পুনরায় নতুন উদ্যমে চালু করতে সহায়তা করার জন্য সরকারি অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। ভাঙচুরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা।

১০. ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা সহজীকরণ করা। ই-কমার্সের গুরুত্ব এবং এর অবদান সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ই-কমার্স খাতের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।

১১. ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে স্মার্টফোন ব্যবহারের ওপর বিশেষ জোর দেয়া উচিত। স্মার্টফোন আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদনে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা উচিত।

১২. স্টার্টআপ সংস্কৃতি উন্নয়নে মেন্টরশিপ ব্যবস্থা, উন্নত ডিজিটাল অবকাঠামো, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির নীতি সহজ করা এবং কর প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি। এটিও খেয়াল রাখতে হবে যে, সরকারি সহায়তার সিদ্ধান্ত যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণ না করা হয়।

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশের ই-কমার্স খাতকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারব।

ডিজিটাল কমার্স আইন
বিগত সরকারের সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স অথোরিটি অ্যাক্ট ২০২৩ চূড়ান্ত করেছে। তবে ই-কমার্সে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এ খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। ফলে এই আইন পুনরায় পর্যালোচনার জন্য বিবেচনা করা করা যেতে পারে। দেশে ই-কমার্স ব্যবসা সম্পর্কিত লিখিত নীতিমালা রয়েছে।

দেশে প্রতিটি ই-কমার্স ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে এবং একইসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল কমার্স পলিসি প্রণয়ন করেছে, যেখানে ই-কমার্স ব্যবসার বিভিন্ন সমস্যা যেমন: হ্যাকিং, কপিরাইট কিংবা প্রোডাক্টের মূল্যজনিত সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট গেটওয়ে এসক্রো সার্ভিস চালু করেছে, যা ই-কমার্সকে করে তুলেছে আরও নিরাপদ।

ই-কমার্স খাতের বিকাশে বিদেশি বিনিয়োগ
ই-কমার্স খাতের বিকাশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে। লাইটক্যাসল পার্টনারসের ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দেশে মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে, যা আগের বছরের থেকে ৫৭ শতাংশ কম। এ থেকে উত্তরণে কর-সংক্রান্ত জটিলতা, নীতিমালাগত অনিশ্চয়তা এবং ট্রেড লজিস্টিকস ও কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দক্ষতা ও উদ্ভাবনের বিকাশ ঘটাতে হবে।

ই কমার্স এর প্রতিষ্ঠাতা কে?
আপনি হয়তো ভাবছেন ই-কমার্সের একজন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠাতা আছেন, যিনি এই বিশাল ব্যবসা জগতের দরজা খুলেছিলেন। কিন্তু আসলে তা নয়। কেননা ই-কমার্সের উদ্ভব এবং বৃদ্ধি অনেক ধীরে ধীরে ঘটেছে। যার সঙ্গে জড়িত ছিলো এক বা একাধিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তির সমন্বয়। কারণ, ১৯৬০-এর দশকে অনলাইন ক্যাটালগের ধারণা আসতে শুরু করেছিলো। যদিওবা তখন ইন্টারনেটের মতো কোনো জিনিস ছিল না, তবুও কমপিউটারের মাধ্যমে তথ্য সংরক্ষণ ও বিনিময়ের চেষ্টা চালিয়েছিলো।

তারপর ১৯৭০-এর দশকে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে পণ্য কেনার ধারণাও জোরালো হয়ে ওঠে। সবশেষে ১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) এর আবিষ্কার ই-কমার্সের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়। তখন মানুষ সহজেই ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে পণ্য খুঁজতে পারতো। তবে অনেকেই মনে করেন যে, ১৯৭৯ সালে মাইকেল অ্যালড্রিচ ইলেকট্রনিক শপিং আবিষ্কার করেন। আর তারপর থেকে তিনি ই-কমার্স এর প্রতিষ্ঠাতা বা উদ্ভাবক হিসেবেও বিবেচিত হয়েছেন।

ই কমার্স কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়?
বর্তমান সময়ের ডিজিটাল যুগে অনলাইনে কেনাকাটা করা আমাদের কাছে এতটাই স্বাভাবিক যে আমরা হয়তো ভুলে যাই যে এই সুবিধাটি কয়েক দশক আগে কল্পনাতীত ছিল। ই-কমার্স, বা ইলেকট্রনিক বাণিজ্য হলো একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা। তবে ১৯৯৫ সালকে ই-কমার্সের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বছরেই দুটি বিশাল ই-কমার্স জায়ান্টের জন্ম হয় অ্যামাজন এবং ইবে।

অ্যামাজন
জেফ বেজোসের দূরদর্শিতার ফসল অ্যামাজন। প্রথমদিকে এটি শুধুমাত্র বই বিক্রি করত, কিন্তু আজ এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন রিটেইলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে। অ্যামাজনের আবির্ভাবের ফলে বই কেনার ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিলো। সেই সময়ে ঘরে বসে কয়েক ক্লিকে যে কোনো বই কেনা সম্ভব হয়ে ওঠেছিলো।

ইবে
পিয়ের ওমিডিয়রের মস্তিষ্ক প্রসূতি হলো ইবে। এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং ব্যবসা থেকে ব্যবসা উভয় ধরনের লেনদেনের জন্য একটি মার্কেটপ্লেস হিসেবে পরিচিতি পায়। ইবেতে মানুষ পুরানো জিনিস থেকে শুরু করে নতুন পণ্য পর্যন্ত যেকোনো কিছু কিনতে বা বিক্রি করতে পারতো।

আর ই-কমার্সের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পেমেন্টের নিরাপদ এবং সহজ পদ্ধতির চাহিদাও বেড়ে যায়। এই চাহিদা মেটাতে ১৯৯৮ সালে পেপ্যাল আবির্ভূত হয়। পেপ্যাল ই-কমার্স পেমেন্টের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুবিধাজনক পদ্ধতি প্রদান করে, যা ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছে। পেপ্যালের আগমনের ফলে অনলাইনে কেনাকাটা আরও নিরাপদ এবং সহজ হয়ে ওঠেছে, যার ফলে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের সূচনা কেমন ছিলো?

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার আগে চলুন ই-কমার্সের শুরুর দিক সম্পর্কে একটু জেনে আসা যাক। বেশির ভাগের মতে, মুনশিজি ছিলো বাংলাদেশের একদম প্রথম ই-কমার্স সাইট। ১৯৯৯ সালে এটির যাত্রা হয়। এই ব্যবসার মূল পণ্য ছিলো সিল্ক, হ্যান্ডিক্রাফটস, চা, পাট ও চামড়ার তৈরি পণ্য ইত্যাদি। এই ই-কমার্স সাইটটি তৈরি করা হয়েছিলো দেশের পণ্য বাইরে রপ্তানি করার উদ্দেশ্যে। তারপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে চালু করা হয় ক্লিক বিডি ডট কম ও সেলবাজার নামে আরও দু’টো ই-কমার্স সাইট।

এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো, বাংলাদেশে জোরেশোরে ই-কমার্সের যাত্রা হয় ২০১১ সাল থেকে। ২০১১ তে এখনি ডট কম নামের ই-কমার্স সাইটটি উন্মোচন করা হয়। পরে যদিও এটির নাম বদলে বাগডুম ডট কম রাখা হয়। ২০১১ তেই আজকের ডিল নামে আরও একটি ই-কমার্স বিজনেস উন্মোচন করা হয়। তারপর ২০১২ তে যখন রকমারি, বিক্রয় ডট কম এবং ২০১৩ সালে চাল ডাল ডট কম ও দারাজের পথচলা শুরু হয়, ২০১৪ সালে কিনলে ডট কম উন্মোচন করা হয় তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে ই-কমার্স বিজনেসের সংখ্যা। বর্তমান সময়ের আরও কিছু সফল কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তার কাজ করে যাছে।

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ই-কমার্সের দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩১ তম, কোন কোন পরিসংখ্যানে আবার ৩৬তম। একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা করা এই ব্যবসা যে দারুণ সম্ভাবনাময় তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশই নেই। ইউএনবি এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের ই-কমার্স এর বাজার ছিলো প্রায় ৫৬৮.৭০ বিলিয়ন টাকা, যা ২০২২ এ প্রায় ৬৬০ বিলিয়ন টাকায় পৌঁছায়। শুধু তাই নয়, আশা করা হচ্ছে ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স বাজার প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছোবে। এটুকু জানার পর এখন আপনারা ধারণা করতে পারছেন আমাদের দেশের ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ কতটুকু সম্ভাবনাময় হতে পারে।

যদি এবার আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগের পরিমাণও আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। দ্যা নিউজ এইজ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সের জন্য বিনিয়োগ ছিলো প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে ১০ মিলিয়ন ডলার ছিলো ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট। এরপর যত সময় গেছে, এই খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। প্রথম আলোর ভাষ্যমতে, ২০১৮ সালে ই-কমার্স জায়েন্ট আলিবাবা দারাজকে অধিগ্রহণ করার পর বাংলাদেশে ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিলো (২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী)। তাই বলা যেতে পারে, বিনিয়োগ বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে ই-কমার্স হয়ে ওঠছে শক্তিশালী ও লাভজনক একটি ক্ষেত্র।

বাংলাদেশের ইন্টারনেট এবং ই-কমার্স গ্রাহক সংখ্যা
বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হওয়ার আরেকটি কারণ হলো আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এমন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ৬৬.৬ মিলিয়ন, যা ২০১৯ এ দাঁড়ায় ৯৬.১৯ মিলিয়নে। ইন্টারনেট গ্রাহক সেপ্টেম্বর ২০২৪, মাসে ১২৪.৮৮ মোবাইল (মিলিয়ন) আইএসপি ও পিএসটিএন ১৩.৭৪ (মিলিয়ন) এবং মোট গ্রাহক ১৩৮.৬২ (মিলিয়ন)।

অ্যাম্পাওয়ারিং অরগানাইজেশন টু স্কেল গ্লোবালি এর তথ্য মতে ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশে ৫২.৯ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল, যা দেশের জনসংখ্যার ৩০.৪% এর সমান। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের আরও কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম যেমন- ইউটিউব ৪.৩৭%, টুইটার ২.৪৪%, ইন্সটাগ্রাম ৬.৫ মিলিয়ন এবং লিঙ্কডইন ৭ মিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ ও টেলিনর ধারণা করছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের ৩২ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি হলেও ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে। আমরা সবাই জানি ই-কমার্স ব্যবসার মূল ভিত্তিই ইন্টারনেট, তাই দেশে ইন্টারনেট ইউজারদের সংখ্যা যত বাড়ছে, ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ তত বেশি উজ্জ্বল হচ্ছে।

ই-কমার্স গ্রাহক বৃদ্ধির কারন
আমরা যদি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, এখন দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজেদের অফিস কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। এরপর একটু সময় বের করে যে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করবেন, সে সময় বা শক্তিও তাদের কাছে থাকেনা। তার ওপর বাইরে বেরোলে ট্রাফিক জ্যাম তো আছেই। এসব কারণে মানুষ এখন বাড়িতে বসে ই-কমার্স ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। যেহেতু এই ওয়েবসাইটগুলোতে পেমেন্ট গেটাওয়ে সংযুক্ত করা থাকে, তাই তারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পেমেন্টও করতে পারছেন। অর্থাৎ ই-কমার্স মানুষের কেনাকাটার কাজটিকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ প্রতিনিয়তই ই-কমার্স সাইট থেকে কেনাকাটা করেন এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং নিশ্চিতভাবেই এ সংখ্যা সামনে আরও বাড়বে।

চার বছরে ই-কমার্সের বাজার ৪১ হাজার কোটি টাকা বাড়বে!
আগামী চার বছরে ই-কমার্সের বাজার আরও প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বাড়বে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে ই-কমার্সের বাজারের আকার ছিল ৬৬০ কোটি ডলার। এই বাজার আগামী চার বছরে আরও বাড়বে। ২০২৬ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর একটি গবেষণার হিসাব দিয়ে ই-কমার্সের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনার এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ফেসবুকে সক্রিয় এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। ২০২৭ সালে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ১৩ লাখ। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে শীর্ষ ১০টির মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে এসেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এর ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে। নাগরিকেরা ফেসবুকে বেশ সক্রিয় এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এই সূচকে ভারত ও ফিলিপাইন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে আছে। করোনা মহামারির ভয়াবহ প্রকোপের মধ্যে ব্যবসা বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর।

মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ভেদে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। করোনাকালীন যেখানে অনেক ব্যবসা, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে সেখানে ই-কমার্সের অনেক প্রতিষ্ঠান অতীতের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পণ্য ডেলিভারি দিয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজার মানুষের। মূলত করোনাকালীন ক্রেতাদের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ভালো করছে। নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

করোনা মহামারির সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছে। ফলে ব্যবসার প্রবৃদ্ধিও ঘটেছে উল্লেখযোগ্য হারে। শহরাঞ্চলের অনেক মানুষ আজকাল অনলাইন কেনাকাটায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। করোনা মহামারির প্রকোপে বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তব প্রয়োজনেই এখন মানুষ ই-কমার্সের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এক্ষেত্রে দারুণ গতির সঞ্চার করার পেছনে বড় কারণ হলো, মানুষ এখন দোকানে দোকানে ঘুরে কেনাকাটা বা বাজার করার চেয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে ঘরে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়টিকে অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করছেন। মহামারির কারণে বিশ্ব জুড়ে অধিকাংশ ভোক্তা ঘরের বাইরে বের হননি। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদি পণ্য থেকে শুরু করে বাগানের জিনিসপত্র সবই তাদের কিনতে হয়েছে অনলাইন থেকে।

দেশীয় বাজারে ই-কমার্সে বেশি কেনা বেচা হয় ফ্যাশন অর্থাৎ জামাকাপড়, শাড়ি, জুতো, খাবার-দাবার, জুয়েলারি ও ইলেকট্রনিক পণ্য। এগুলোর লেনদেন হয় নগদ টাকায় এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমে। ই-কমার্সের দেশীয় বাজার প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হলে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তা না হলে প্রতিবেশী দেশের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা বাজার দখল করবে।

ই-কমার্সের বিস্তৃতির জন্য সরকারকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। কারণ সরকারিভাবে ব্যবসা বাণিজ্য আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখনও ই-কমার্স নিয়ে সরকারিভাবে কোনো নীতিমালা প্রণীত হয়নি। নীতিমালা না থাকার কারণে ই-কমার্সে প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে আস্থার ঘাটতি তৈরি হতে পারে। যা ই-কমার্সের বিকাশের পথে বিরাট বাধা হয়ে উঠতে পারে। ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর আদায় বাড়াতে হলে রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন। আবার কর সুবিধা যৌক্তিকভাবে দিতে হবে।

ডিজিটাল অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে এ খাত থেকে কর আদায়ে জোর দেওয়া দরকার। ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণ হলেও কাঙ্ক্ষিত কর আদায় করা যাচ্ছে না। কর দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। হয়রানি বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের কাছে কর আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে এসেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এর ব্যবসা সম্প্রসারিত হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজনসহ ৯টি অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাত্র ৫৮ কোটি টাকার মতো ভ্যাট পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সব মিলিয়ে কর মিলেছে ৩৮৫ কোটি টাকা। গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনসহ ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছর ২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ২০১৯ সালের হিসাবে, দেশের পাঁচটি মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠান আগের পাঁচ বছরে গুগল, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানকে ৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ডিজিটাল বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কিন্তু এনবিআরের হিসাব বলছে, মাত্র ১৩৩ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফরম থেকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ১৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার পাবে এবং ২০২৭ সাল নাগাদ এই প্ল্যাটফরম ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ১৩ লাখ। নেটফ্লিক্সের বাংলাদেশে গ্রাহকসংখ্যা এখন ২ লাখ। বছরে আয় ২০০ কোটি টাকা। চরকি, বায়োস্কোপ, টফির মতো দেশি ওটিটি প্ল্যাটফরমও আছে। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ে শীর্ষ ১০টির মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অবকাশ-সুবিধা, নগদ সহায়তাসহ নানা প্রণোদনা দেয় সরকার। তবে আগামী জুন মাসে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অবকাশ-সুবিধা ওঠে যাচ্ছে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা বিক্রিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘ছায়া’ আছে; কিন্তু বডি নেই। এ দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকতে হবে। ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর আদায় বাড়াতে হলে কর প্রশাসনকে দক্ষ করতে হবে। তবে ডিজিটাল অর্থনীতিতে কোথা থেকে আয় সৃষ্টি হচ্ছে, তা অনেক সময় জানা যায় না। ফলে কর আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। ঝামেলাহীনভাবে শুল্ক-কর দেওয়ার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অনেক উদ্যোক্তা গড়ে ওঠবে।

অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে সম্ভাবনার নানা দিগন্ত উন্মোচিত হলেও বেশ কিছু সমস্যা এখন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা হলো প্রতারণা। কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের নানাভাবে ঠকাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করছে না। প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে ই-কমার্স ব্যবসা আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রতিষ্ঠানগুলোর লোভনীয় অফারে এবং বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। কেউ কেউ প্রিঅর্ডারের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। বর্তমানে দেশে যে ই-কমার্স সাইটগুলো রয়েছে তার সবগুলো বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে পারছে না। কিছু প্রতিষ্ঠান সঠিক মানের পণ্য, সঠিক দাম নিশ্চিত করে না, ফলে ক্রেতারা প্রতারিত ও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এর প্রতিকারে ই-কমার্সকে বিশেষ নীতিমালার আওতায় আনা প্রয়োজন।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে কয়েকটি সম্ভাবনাময় ব্যবসার খাত রয়েছে ই-কমার্স সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের জিডিপির হার বাড়িয়ে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন আনতে ই-কমার্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদি ই-কমার্স খাতে থাকা বর্তমান সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে এটি হয়ে ওঠবে বাংলাদেশের অন্যতম সফল ও শক্তিশালী খাত।
সর্বোপরি, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে আমরা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও সহায়ক নীতিমালা প্রত্যাশা করছি, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *