প্রতিবেদন

বাংলাদেশের প্রযুক্তি পণ্যের হৃদস্পন্দন: বিসিএস কমপিউটার সিটি

ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ (তুষার): ঢাকার আগারগাঁওয়ের ব্যস্ততম এলাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল প্রযুক্তির দুর্গ-বিসিএস কমপিউটার সিটি। বাইরে থেকে দেখলে এটি কেবল একটি ভবন মনে হবে, কিন্তু ভেতরে পা রাখলেই বোঝা যায়, এটিই বাংলাদেশের প্রযুক্তিপণ্য ব্যবসার সবচেয়ে প্রাণবন্ত কেন্দ্র। আইডিবি ভবন শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এই ভবনের ভেতরেই অবস্থিত বিসিএস কমপিউটার সিটি, যা দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের বিশেষায়িত প্রযুক্তিপণ্যের বাজার। প্রযুক্তিপ্রেমী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের কাছে এটি যেন এক অনন্য গন্তব্য।

সময়টা ছিল ১৯৯৯ সাল। তখন ইন্টারনেট ছিল বিলাসিতা, কমপিউটার মানেই অজানা বিস্ময়। সে সময় দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত ছিল নবযাত্রার পর্যায়ে। সে সময়ই বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস) সিদ্ধান্ত নেয়- দেশে এমন একটি বাজার গড়ে তোলা হবে যেখানে মানুষ এক জায়গায় সব প্রযুক্তিপণ্য পাবে, ব্যবসায়ীরা কাজ করবেন সংগঠিতভাবে, আর প্রযুক্তিপণ্য সাধারণের নাগালের ভেতর আসবে। সেই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নেয় বিসিএস কমপিউটার সিটি, আইডিবি ভবনের অভ্যন্তরে।

বিসিএস কমপিউটার সিটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য হলো দেশব্যাপী প্রযুক্তি বিস্তারে সহায়তা করা, উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা ও সাধারণ মানুষের কাছে প্রযুক্তিপণ্যকে সহজলভ্য করে তোলা। বর্তমানে এই বিশেষায়িত বাজারে রয়েছে প্রায় ১৫০টির বেশি দোকান ও প্রদর্শনী কেন্দ্র। যেখানে পাওয়া যায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তিপণ্য যেমন- ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোকপি মেশিন, নেটওয়ার্কিং পণ্য, গেমিং অ্যাকসেসরিজ, সিসিটিভি ও বিভিন্ন প্রযুক্তিপন্যের গ্যাজেট। এ ছাড়াও রিপেয়ারিং, সফটওয়্যার ইন্সটলেশন, আপগ্রেডিং এবং নেটওয়ার্ক সাপোর্ট সার্ভিসও দেয়া হয়।

বিসিএস কমপিউটার সিটিতে প্রবেশ করলেই মনে হয়, আপনি যেন ঢাকার ভেতর আরেকটি ছোট্ট টেক সিটি-তে প্রবেশ করলেন। চোখে পড়ে সারি সারি দোকান, উজ্জ্বল লাইটবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে পরিচিত বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিপণ্যের ব্র্যান্ডের নাম। এখানে আসা প্রতিটি মানুষ যেন প্রযুক্তির গল্প নিয়ে এসেছে। কেউ নতুন ল্যাপটপ কিনতে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু করার আগে, কেউ বা অফিসের জন্য নেটওয়ার্ক সেটআপ নিচ্ছে।

বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের প্রযুক্তিখাতের প্রবণতা ও গ্রাহকের চাহিদার পরিবর্তন সবচেয়ে দ্রুত টের পাওয়া যায় এখানেই। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অফিস পেশাজীবী, এমনকি সরকারি ক্রেতারাও এখানে নিয়মিত আসেন প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিপণ্যের সরঞ্জাম কিনতে। আর এক জায়গায় সব পাওয়া যায়, মূল্য প্রতিযোগিতামূলক, আর সার্ভিসও ভালো। বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল রুপান্তর গড়ার পথে অগ্রসর, তখন এই বাজার তার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এখান থেকেই জন্ম নিচ্ছে হাজারও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, যারা সারা দেশে আইটি সেবা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

প্রযুক্তিপ্রেমীদের জন্য বিসিএস কমপিউটার সিটি শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, এটি এক ধরনের উৎসবমুখর অভিজ্ঞতা। বছর জুড়ে এখানে আয়োজন করা হয় সিটি আইটি মেগা ফেয়ার, আইটি ঈদ ফেস্ট, সিকিউরিটি ফেয়ার, ইন্টারঅ্যাক্টিভ ফ্ল্যাট প্যানেল ফেয়ার, ফ্রি সার্ভিস ফেস্ট, গেমিং এক্সপো- নাম শুনলেই বোঝা যায়, এটি এখন দেশের ডিজিটাল সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। যা তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহী করে তুলছে এবং স্থানীয় বাজারে আধুনিক প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা বাড়াচ্ছে।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে বিসিএস কমপিউটার সিটি আস্থার ২৬ বছর পূর্তি এবং ২৭ বছরে পদার্পন উপলক্ষে বিসিএস কমপিউটার সিটি ব্যবস্থাপনা কমিটি আয়োজন করছে ‘সিটি আইটি মেগা ফেয়ার-২০২৫’। ‘প্রযুক্তির শক্তি, তারুণ্যে অগ্রগতি’ স্লোগানে সর্বশেষ সংস্করণের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্যের সমাহার নিয়ে কাল থেকে শুরু হচ্ছে ছয় দিনব্যাপী (৮-১৩ ডিসেম্বর) ‘‘সিটি আইটি মেগা ফেয়ার-২০২৫’’।

‘সিটি আইটি মেগা ফেয়ার-২০২৫’ প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই মেলা। মেলায় বিনামূল্যে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। মেলায় থাকছে প্রতিটি প্রযুক্তি পণ্য ক্রয়ে আকর্ষণীয় মূল্যছাড় ও পুরস্কার, ক্যাশব্যাক, স্ক্র্যাচ অ্যান্ড উইন অফার, সঠিক পণ্যের নিশ্চয়তা। পাশাপাশি থাকছে গেমিং এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন থাকছে কনসার্ট ও র‍্যাফেল ড্র এর আয়োজন।

আগামীকাল সোমবার (৮ ডিসেম্বর) বিসিএস কমপিউটার সিটির নিচতলায় মেলা প্রাঙ্গণে ‘সিটি আইটি মেগা ফেয়ার-২০২৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন প্রধান অতিথি বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস)-এর সভাপতি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম; বিশেষ অতিথি বিসিএস কমপিউটার সিটি ব্যবস্থাপনা কমিটির উপদেষ্টাদ্বয় মোহাম্মদ জসিম উদ্দীন খোন্দকার এবং গৌতম সাহা। সভাপতিত্ব করবেন বিসিএস কমপিউটার সিটি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আকতার হোসেন খান এবং পরিচালনা করবেন মহাসচিব ও মেলার আহবায়ক মো. জাহেদ আলী ভূঁইয়া।

মেলা প্রসঙ্গে আকতার হোসেন খান বলেন, “এবারের মেলা জুড়ে থাকবে সর্বশেষ সংস্করণের অত্যাধুনিক কমপিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মনিটর ও সিসি ক্যামেরা সহ নিত্য নতুন প্রযুক্তিপণ্যের সমাহার। মেলায় কেনাকাটায় ছাড়ের পাশাপাশি ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য থাকবে নানা ধরনের আয়োজন। শিশু-কিশোরদের জন্য থাকবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।”

মো. জাহেদ আলী ভূঁইয়া বলেন, “দেশের বৃহত্তম প্রযুক্তিপণ্যের এই মেলা উপলক্ষ্যে মার্কেট জুড়েই থাকবে নানা ধরনের অফার-মূল্যছাড়। মেলায় স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের প্যাভিলিয়ন এবং পার্টিসিপেন্ট স্টল থাকছে। মেলার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে থাকছে আসুস, এপসন, এইচপি, এলডিনিও, লেনোভো, এমএসআই এবং টিপি-লিংক। মেলায় স্টলগুলোর মধ্যে থাকছে চুউই ল্যাপটপ, প্যান্টাম, ডেল, ওয়ালটন, ডিপকুল, এসার, বি-ট্র্যাক, টি এন্ড ভি, কিউডি, রাপু, ভেনশন। মেলার চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পৃষ্ঠপোষক গিগাবাইট।”

‘সিটি আইটি মেগা ফেয়ার-২০২৫’ এই মেলার মধ্য দিয়ে ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের একটি মিলনমেলা তৈরি হয়। এই মেলার মাধ্যমে প্রযুক্তিপ্রেমী ক্রেতারা এক ছাদের নিচে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পান। শিক্ষার্থী, তরুণ উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার থেকে শুরু করে আইটি প্রফেশনাল সবার জন্য এটি হবে এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি মেলা নয়, বরং বাংলাদেশের প্রযুক্তি শিল্পের সবচেয়ে বড় মিলনমেলা।

বিসিএস কমপিউটার সিটি এখন শুধু প্রযুক্তিপণ্যের বাজার নয়; এটি একটি টেকনোলজি হাব। ভবিষ্যতে এখানে স্টার্টআপ জোন, স্মার্ট সলিউশন গ্যালারি এবং আইটি ট্রেনিং সেন্টার চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিসিএস কমপিউটার সিটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের নীরব চালিকা শক্তি হয়ে কাজ করছে। এখান থেকেই গড়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *