বন্ধ হচ্ছে ক্যাশ সার্ভার: ইন্টারনেটের গতি কমবে, খরচ বাড়বে
সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করার জন্য ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। বলা যায় এই ধরনের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন হলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া ও ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলোতে বাফারিং সমস্যায় ভুগবে, ইন্টারনেটের লোড ব্যালেন্সিং ক্ষমতা কমে যাবে, মূল ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের ওপর চাপ বাড়বে অথবা ইন্টারনেট খরচ বেড়ে যাবে কয়েকগুন। ক্যাশ সার্ভার বন্ধ হওয়ার পর কেনো ইন্টারনেটের গতি কমবে এবং খরচ বাড়বে তাই নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন….সালাউদ্দিন সেলিম
ক্যাশ সার্ভার কি?
ক্যাশ সার্ভার মূলত মূল সার্ভার ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুরুত্ব কমানো এবং সার্ভার ও ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের লোড ব্যালেন্সিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। সহজ ভাষায়, যেমন ইউটিউব ও ফেসবুকের মূল সার্ভার রয়েছে আমেরিকাতে কিন্তু ইউটিউব ও ফেসবুক ব্যবহার করার সময় আপনাকে যদি সরাসরি আমেরিকার সার্ভার থেকে ডাটা পেতে হয় তাহলে তা হবে অতিমাত্রায় ধীরগতির। তাই এই সমস্যা সমাধানে ইউটিউব, ফেসবুকসহ অধিকাংশ প্ল্যাটফর্মই এখন ব্যবহার করে ক্যাশিং প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ইন্টারনেট প্রোভাইডারদেরকে প্রদান করা হয়েছে ক্যাশ সার্ভার, যার কাজ হলো মূল সার্ভারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যুক্ত থেকে মূল সার্ভারের হুবুহু তথ্য ক্যাশ সার্ভারে নিয়ে আসা। ব্যবহারকারী যখন ইউটিউব কিংবা ফেসবুক কিংবা এ জাতীয় অন্যান্য সেবা ব্যবহার করবেন তখন সেটি আর আমেরিকার সার্ভারকে খুঁজবে না তখন কাছাকাছি যে সার্ভারটি আছে সেটি থেকেই ডাটা নিয়ে আপনাকে প্রদর্শন করবে। ব্যাপারটা অনেকটা লোকাল নেটওয়ার্কের মতো।
মূলত একজন ব্যবহারকারী যখন ইউটিউব কিংবা ফেসবুক ব্যবহার করে তখন ঐ নেটওয়ার্কে তার রিকয়েস্টটা পাসথ্রু হয়ে সরাসরি ইউটিউব ও ফেসবুকের ক্যাশ সার্ভারের সংযুক্ত হয় যার ফলে মেইন ইন্টারনেট ব্যান্ডউডথের ওপর এর প্রভাব পড়ে না। এই কারণে ক্যাশ সার্ভার শুধু ইউজারদের বাফার ফ্রি ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহারের সুবিধাই দেয় না, পাশাপাশি মেইন ইন্টারনেটের ওপরও চাপও কমায় যা লোড ব্যালেন্স হিসেবে কাজ করে। লক্ষ করলে দেখবেন অনেক সময় ওয়েবসাইট ব্রাউজ করার সময় স্লো গতির হলেও ইউটিউব ও ফেসবুকের পারফরমেন্স কিন্তু অনেক দ্রুতগতির, কারণ বাংলাদেশে শতাধিক ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছে রয়েছে ইউটিউব ও ফেসবুকের ক্যাশ সার্ভার। এবং ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার সময় আইএসপিগুলো ইন্টারনেটের স্পীড ও ফেসবুক, ইউটিউবের স্পীড আলাদা করে উল্লেখ করে থাকেন। এটা সম্ভব হয় এই ক্যাশ সার্ভারের কারণেই।
এই সিদ্ধান্ত বোকামী ছাড়া কিছু নয়!
সারা বিশ্বের ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে বদলে দিয়েছে এই ক্যাশিং প্রযুক্তি। এখন শুধু ইউটিউব ও ফেসবুক-ই নয় বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের ইন্টারনেটনির্ভর সেবাকে গ্রাহকের কাছে গতিময় করে তুলতে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যাশ সার্ভার বা ক্যাশিং প্রযুক্তি। শুধুমাত্র ক্যাশিং সুবিধার কারণে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গ্রাহক বেড়েছে কয়েকগুন । যারা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে ভিডিও ক্রিয়েটর ও ই-কমার্সের কাজ করেন, ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন তাদের জন্য ক্যাশ সার্ভার এনে দিয়েছে আমূল পরিবর্তন ও অনেক সুবিধা। বলা যায় এই সুবিধার মাধ্যমে বিদেশী রেমিটেন্স বেড়েছে কয়েকগুন, প্রতিমাসে আসছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। কারণ বাফারলেস ভিডিও প্লে ও দ্রুতগতির ব্রাউজিং সুবিধা পাওয়াতে দেশে যেমন বিনোদনপ্রেমী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ঠিক পাশাপাশি বিনোদনের যোগান দিতে ভিডিও ক্রিয়েটরদের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুনে।
বিটিআরসির এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তই বলে দেয় এই ক্যাশ প্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা কতটা দূর্বল। যদিও বিটিআরসি বলেছে আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাশ বন্ধ হবে অর্থাত মূল গেটওয়েগুলো বাদে অন্যান্য শাখা প্রশাখার ইন্টানেট প্রোভাইডারগুলোতে ক্যাশ সার্ভার বন্ধ থাকবে, কিন্তু এই তথ্য থেকে অনুমেয় যে, কোন স্বার্থানেস্বী মহল এক চেটিয়া ক্যাশ সার্ভারের ব্যান্ডউইডথের ব্যবসা করার নীল নকশা এঁকেছে এবং বিটিআরসি তাদেরকে সহযোগিতা করছে।
আমি বলবো প্রতিদিন কি পরিমাণ ইউটিউব ও ফেসবুকের ব্যান্ডইউডথ ব্যবহারকারীরা ব্যবহার করে থাকে তার কোন ধারণাই বিটিআরসির কাছে নেই, তা থাকলে কখনোই এই সিদ্ধান্ত আসতো না। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাশ সার্ভারের মাধ্যমে সারা দেশের ব্যবহারকারীদের সেবা পেতে হবে যার ভোগান্তি পেতে হবে ব্যবহারকারীদেরকেই। কারণ ইন্টারনেটের ব্যান্ডউডথের প্রয়োজনই পড়ে ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার করতে, সাধারণ একটি ওয়েবসাইট ব্রাউজ করতে তো তেমন ব্যান্ডইউডথ প্রয়োজন পড়ে না। বর্তমানে একজন গ্রাহক মাত্র ৫০০ টাকার ইন্টারনেট দিয়েও তার সকল কাজ চালিয়ে নিতে পারে কারণ ক্যাশ সুবিধার কারনে ওই ৫০০ টাকার ইন্টারনেট দিয়েও ফোরকে মুভি দেখতে পারে।
কিন্তু ক্যাশ সার্ভার বন্ধ হয়ে গেলে তখন আর ৫০০ টাকার ইন্টারনেট দিয়ে কোন কাজ হবে না তখন একটি ফোরকে মুভি দেখতেও প্রয়োজন পড়বে কমপক্ষে ৫এমবিপিএস ডেডিকেটেড ব্যান্ডউডথ যার দাম পড়বে মাসে কমপক্ষে ২০০০টাকা (এটি একটি উদাহারণ মাত্র)। আর আমাদের দেশের বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুক ও ইউটিউব দেখার কাজে। তাহলে বুঝতেই পারছেন ভোগান্তি কোথায় গিয়ে দাড়াতে পারে। যেখানে সরকার চেষ্টা করছে সারা দেশে সর্বত্র ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে, এক দেশ এক রেট এ ইন্টারনেট সুবিধা দিতে, সেখানে হঠাত ক্যাশ সার্ভার বন্ধের সিদ্ধান্ত বলা যায় নিজেদের সঙ্গে নিজেদেরই বিরোধিতা, দেশের ব্যবহারকারীদেরকে বিপদে ফেলা।
ক্যাশ সার্ভার বন্ধের পক্ষে খোড়া যুক্তি!
ক্যাশ সার্ভার বন্ধের কারণ হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে বিটিআরসি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে ক্যাশ সার্ভারের সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুকির কোন সম্পর্ক নেই, কারণ ক্যাশ সার্ভার মূলত মূল সার্ভারের রেপ্লিকা মাত্র, এর মাধ্যমে সাইবার অ্যাটাক হতে পারে এই ধরনের ধারণা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। বিটিআরসির মতো একটি হাইটেক প্রতিষ্ঠানের এমন যুক্তি সত্যিই হাস্যকর! কোন কনটেন্ট ফিল্টার করার ক্ষেত্রে মূল গেটওয়ে থেকেই করা যায় যা প্রতিনিয়তই করা হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন এ ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শী।
নিরাপত্তা ঝুকির কারণ দেখিয়ে ক্যাশ সার্ভার বন্ধের কথা বলা হলেও আদৌ কি সেটা সম্ভব? ধারণা করা হচ্ছে ফেসবুক ইউটিউবে বিভিন্ন কনটেন্ট প্রয়োজনে বন্ধ করার জন্য ক্যাশ সার্ভারকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। অতি উদ্যোগি কেউ কেউ কর্তৃপক্ষকে নাকি বুঝিয়েছেন কোন কনটেন্ট মূল গেটওয়ে থেকে বন্ধ করলেও নাকি লোকাল আইএসপি চাইলে তা প্রাইভেট নেটওয়ার্কে চালু রাখতে পারে। ফেসবুক ও ইউটিউবের ক্যাশ সার্ভারের ক্ষেত্রে এটি পুরোটাই ভ্রান্ত ধারণা। কারণ ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে যে ক্যাশ সার্ভার পাঠানো হয় তাতে পাওয়ার অন ও নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি দেওয়ার ছাড়া আইএসপিগুলোর আর কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ নেই। তা ছাড়া একটি কনটেন্টের ইউআরএল ক্যাশ সার্ভার তৈরি হয় না, এটি তৈরি হয় ফেসবুক ও ইউটিউবের মূল সার্ভারে। কোন কনটেন্টের ইউআরএল আলাদা করে প্রাইভেট নেটওয়ার্কে সচল রাখা কখনোই সম্ভব নয়।
বন্ধ নয়, নিয়ন্ত্রণে রাখুন
ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করে কোন সমাধান মিলবে না বরং ভোগান্তি বাড়বে ব্যবহারকারীদের। তাই প্রয়োজনে সারা দেশে কোন কোন আইএসপিতে ক্যাশ সার্ভার আছে, কি আইপি ব্যবহৃত হচ্ছে তার হিসেব রাখুন। সারা দেশে সার্ভার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নিয়ম ও গাইডলাইন তৈরি করুন ব্যবহারকারী ও আইএসপি সবাই উপকৃত হয়।
আসুন আমরা সামনে এগুই পেছনে নয়…
আমাদের দেশে অতীতেও শুধুমাত্র আমাদের নীতি নির্ধারকদের প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে প্রযুক্তির অনেক বড় বড় সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। তাই এরকম ভুল সিদ্ধান্ত আর নয়। যে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নিজেই একজন উচ্চমানের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সেই দেশে এমন একটি খোড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশ পিছিয়ে পড়বে, পাশের দেশগুলো আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে, আর আমাদের প্রজন্ম বঞ্চিত হবে অনেক সুবিধা থেকেই।