প্রতিবেদন

প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারির নতুন দিগন্ত: বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা (বডিক্যাম)

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যেমন আমাদের দৈনন্দিন কাজ সহজ হচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রেও যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হলো বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা, যা সংক্ষেপে বডিক্যাম নামে পরিচিত। এটি মূলত একটি পোর্টেবল ক্যামেরা, যা পোশাক বা ইউনিফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং চারপাশের ঘটনাগুলো ভিডিও ও অডিও ধারণ করে।

বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা (বডিক্যাম)-এর ইতিহাস ও সূচনা
বডিক্যাম এর ব্যবহার সাম্প্রতিক মনে হলেও এর মূল ধারণাটি অনেক পুরোনো। প্রথম দিকে এর ব্যবহার ছিল মূলত বাণিজ্যিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে। তবে এর আধুনিক রূপটি মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে সামরিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সীমিত আকারে এর ব্যবহার শুরু হলেও, ১৯৯০-এর দশকে কিছু পুলিশ বিভাগ পরীক্ষামূলকভাবে এর ব্যবহার শুরু করে। তবে এর ব্যাপক প্রচার ও ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালের পর থেকে, যখন পোর্টেবল এবং উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা সহজলভ্য হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যের রেভার পুলিশ বিভাগকে প্রায়শই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বডিক্যাম ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা মূলত জনসাধারণের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের মিথস্ক্রিয়া এবং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে এটি ব্যবহার করে। এই ক্যামেরাগুলো তখন আকারে অনেক বড় ছিল এবং কার্যকারিতাও সীমিত ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে বডিক্যামগুলো আরও ছোট, কার্যকর এবং উন্নত মানের হয়েছে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা

বডিক্যাম এর ব্যবহারিক ক্ষেত্র ও কার্যক্রম
বডিক্যাম শুধু পুলিশি কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই, এর ব্যবহার এখন বিভিন্ন পেশায় বিস্তৃত। এর প্রধান লক্ষ্য হলো ঘটনার যথাযথ ও নিরপেক্ষ প্রমাণ ধারণ করা। সাধারণত যেসব পেশায় জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়, সেখানেই এর ব্যবহার বেশি দেখা যায়। প্রধান ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলো হলো-
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী: পুলিশ, শেরিফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বডিক্যামের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী। টহল, গ্রেপ্তার, তল্লাশি, যানবাহন তল্লাশি এবং জনসাধারণের সঙ্গে কথোপকথনের সময় বডিক্যাম চালু থাকে। এর ফলে ঘটনার একটি অখণ্ড ও নির্ভরযোগ্য চিত্র পাওয়া যায়।
জরুরি সেবা: ফায়ারফাইটার (দমকলকর্মী), অ্যাম্বুলেন্স কর্মী এবং প্যারামেডিকরা জরুরি পরিস্থিতিতে বডিক্যাম ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা ঘটনাস্থলের অবস্থা, রোগীর পরিস্থিতি এবং ঝুঁকির মাত্রা সঠিকভাবে রেকর্ড করতে পারেন, যা পরবর্তীতে প্রশিক্ষণ ও পর্যালোচনায় কাজে লাগে।

নিরাপত্তা কর্মী: শপিং মল, স্টেডিয়াম, ব্যক্তিগত ভবন বা বড় অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মীরাও বডিক্যাম ব্যবহার করেন। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, চুরি, বা বিশৃঙ্খলার সময় সঠিক প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হয়।
পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন: সরকারি পরিদর্শক, স্বাস্থ্য পরিদর্শক এবং পরিবেশ পরিদর্শকরা তাদের কাজে স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা বাড়াতে এটি ব্যবহার করতে পারেন।
খুচরা ব্যবসা: বড় খুচরা দোকানে কর্মীরা চুরি বা গ্রাহকদের সঙ্গে বিতর্কের সময় বডিক্যাম ব্যবহার করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেন।

বডিক্যাম এর ভালো দিক ও উপকারিতা
বডিক্যাম ব্যবহারের অনেক সুবিধা রয়েছে, যা পেশাদার এবং সাধারণ মানুষ উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যারা এটি ব্যবহার করেন বা করতে পারেন, তাদের জন্য এর কিছু বিশেষ উপকারিতা নিচে তুলে ধরা হলো-
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি: বডিক্যামের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। যখন একজন কর্মকর্তা জানেন যে তার প্রতিটি পদক্ষেপ রেকর্ড হচ্ছে, তখন তিনি নিয়ম মেনে কাজ করতে বাধ্য হন। এতে জনগণের কাছে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।

নিরপেক্ষ প্রমাণ সংগ্রহ: কোনও ঘটনা, যেমন – সংঘর্ষ, অভিযোগ বা অপরাধের সময় বডিক্যামের ফুটেজ একটি নিরপেক্ষ প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। এটি আদালত এবং অভ্যন্তরীণ তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং ভুল অভিযোগ থেকে কর্মকর্তাদের রক্ষা করে।

অফিসার এবং জনগণের নিরাপত্তা: বডিক্যাম ব্যবহার করার ফলে অনেক সময় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি বা সহিংসতা এড়ানো যায়। কারণ, যখন কেউ জানতে পারে যে তার কর্মকাণ্ড রেকর্ড হচ্ছে, তখন সে শান্ত থাকতে চেষ্টা করে। এতে অফিসার এবং সাধারণ মানুষ উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

প্রশিক্ষণ ও পর্যালোচনা: বডিক্যাম থেকে প্রাপ্ত ফুটেজ নতুন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। প্রশিক্ষকরা বাস্তব জীবনের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এবং ভুলগুলো চিহ্নিত করে সঠিক কৌশল শেখাতে পারেন।

বিরোধ নিষ্পত্তি: বডিক্যামের রেকর্ডিং বিভিন্ন অভিযোগ ও বিতর্কের দ্রুত সমাধানে সাহায্য করে। কোনও ঘটনার পর যদি কোনও পক্ষ মিথ্যা অভিযোগ করে, তাহলে ফুটেজ দিয়ে তা সহজেই যাচাই করা যায়।

বিশ্বজুড়ে বডিক্যাম এর ব্যবহার
বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই বডিক্যামের ব্যবহার প্রচলিত। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এটি একটি অপরিহার্য প্রযুক্তি হয়ে ওঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র: বডিক্যামের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই পুলিশ বডিক্যাম ব্যবহার করে।
যুক্তরাজ্য: লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশসহ অন্যান্য পুলিশ বাহিনীতে বডিক্যাম ব্যাপক জনপ্রিয়।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড: এসব দেশেও পুলিশ বডিক্যাম ব্যবহার করে এবং এর ফলাফল বেশ ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
চীন ও ভারত: এই দেশগুলোতেও বিভিন্ন শহরের পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী পরীক্ষামূলকভাবে এবং সীমিত পরিসরে বডিক্যাম ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশে বডিক্যাম এর ব্যবহার
বাংলাদেশেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশকে বডিক্যাম ব্যবহার করতে দেখা গেছে। যদিও এর ব্যবহার এখনও সীমিত, তবে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোচনা চলছে। প্রাথমিকভাবে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কিছু ইউনিট এবং ট্রাফিক পুলিশকে পরীক্ষামূলকভাবে বডিক্যাম ব্যবহার করতে দেখা যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা এবং ট্রাফিক আইন প্রয়োগে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বডিক্যাম ব্যবহার
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে ৪৭ হাজার কেন্দ্রে একটি করে বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা দেয়া হবে। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদার করতে বডি-ওয়ার্ন ক্যামেরা (বডিক্যাম) ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এসব ক্যামেরা দিয়ে দূর থেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা। নির্বাচন কীভাবে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, সেই জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রত্যেকটি ভোটকেন্দ্রের জন্য এই বডি ক্যাম ব্যবহার করা হবে।

ভবিষ্যতের পথচলা
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বডিক্যামও আরও উন্নত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত বডিক্যাম এখন এমন অনেক কাজ করতে পারে, যা আগে সম্ভব ছিল না। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্ত্র সনাক্ত করতে পারে বা কোনও হুমকির ইঙ্গিত দিতে পারে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম আরও নিরাপদ এবং কার্যকর হবে। বডিক্যামের ব্যবহার নিয়ে গোপনীয়তা এবং ডেটা সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও, এর বহুমুখী সুবিধা এটিকে একটি আধুনিক এবং অপরিহার্য প্রযুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভবিষ্যতের দিনগুলোতে বডিক্যাম শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যই নয়, বরং বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য একটি শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *