প্রতিবেদন

নকল প্রযুক্তি পণ্য রোধে ক্রেতা ও বিক্রেতার করণীয়

বাংলাদেশে প্রযুক্তি পণ্য ও সার্ভিসের গুণগত মান ক্রমাগত উন্নতি করছে এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মত অবস্থানে এগিয়ে আসছে। দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মানের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরি এবং সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে। আইসিটি খাতে দক্ষ জনবল এবং প্রযুক্তি অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্ববাজারে আইসিটি সার্ভিস আউটসোর্সিংয়ের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে ওঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ থাকলেও, সামগ্রিকভাবে দেশের আইসিটি খাত আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ প্রতিযোগিতামূলক এবং দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

সামগ্রীকভাবে দেশের আইসিটি খাত উন্নতির দ্বারপ্রান্তে গেলেও দেশের বাজারে দেদারসে পাওয়া যাচ্ছে নকল প্রযুক্তি পণ্য পাশাপাশি গ্রে পণ্য (নন চ্যানেল), ব্যবহৃত পণ্য। প্রযুক্তি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের বেশ বেগ পেতে হয়। কোনটি আসল পণ্য আর কোনটি নকল পণ্য, ক্রেতার পক্ষে তা বুঝে ওঠা মুশকিল যে, তিনি নকল পণ্য কিনছেন। নকল প্রযুক্তি পণ্য চেনার কিছু উপায় রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ক্রেতা ও বিক্রেতার ভুমিকা কি হতে পারে তা তুলে ধরেছেন হাসান রিয়াজ জিতু……

হাসান রিয়াজ (জিতু)

নকল প্রযুক্তি পণ্য চেনার কিছু উপায় রয়েছে। পণ্যের লোগো বা মনোগ্রাম, হলোগ্রাম স্টিকার দেখা, পার্ট নম্বর খুঁজে বের করা, নতুন কেনা পণ্যটি মসৃণ বা স্মুদ কিনা এসব ভালোভাবে খেয়াল করলেও কিছু কিছু নকল পণ্য চেনা সম্ভব। এমনকি কোনও পণ্য কেনার আগে একাধিক দোকান যাচাই বাছাই করা। অনুমোদিত পরিবেশককে খুঁজে বের করে সেখান থেকে পণ্যের মূল্য যাচাই করেও আসল-নকল চেনা সম্ভব।

নকল পণ্য চেনার ক্ষেত্রে প্রতিটি পণ্যের গায়ে পার্ট নম্বর দেয়া আছে। ওই নম্বর ক্রয়কৃত পণ্যটির সাইটে গিয়ে পরীক্ষা করলে পণ্যের ছবি, উৎপাদনের তারিখ সহ সব তথ্য চলে আসবে চোখের সামনে। অনুমোদিত পরিবেশকের কাছ থেকে ক্রয় করলে নকল পণ্য কেনার কোনও শঙ্কা থাকবে না। নকল পণ্যের সঙ্গে আসল পণ্যের মূল্যের অনেক পার্থক্য থাকে। নকল পণ্য দিয়ে কোনও রকমে কাজ করা গেলেও তা বেশিদিন টেকসই হয় না। ওয়ারেন্টি পাওয়া যায় না। দুই-তিন মাসের মধ্যে সমস্যা ধরা পড়ে।

আসল প্রযুক্তি পণ্য চেনার উপায়
আসল প্রযুক্তি পণ্য চেনার অন্যতম উপায় হলো এটি অনুমোদিত পরিবেশক বা পরিবেশকদের অনুমোদিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয় করা। দেশের বাজারে যে সকল বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি পণ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে তাদের অনুমোদিত পরিবেশক রয়েছে এ দেশে।

ইতিমধ্যে নকল পণ্য ক্রয় থেকে ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন পরিবেশক প্রতিষ্ঠান পণ্যের গায়ে কিউআর কোড স্থাপন করেছে। সেই কোড স্ক্যান করে পণ্যের মান ও ওয়ারেন্টি যাচাই করা যায়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের হলোগ্রাম স্টিকার, ওয়ারেন্টি স্টিকারের মাধ্যমে প্রতিটি পণ্যের সিরিয়াল নম্বর দিয়ে ওয়ারেন্টি এবং পণ্যটির আসল তথ্য যাচাই করা সম্ভব। পণ্যের প্যাকেজিং, বিল এবং নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতীক বা লোগো খেয়াল করা উচিত।

প্রযুক্তি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের করণীয়
প্রযুক্তিপ্রেমী ক্রেতাদের উচিত পণ্য কেনার আগে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ড বা মডেলের ব্যাপারে যথেষ্ট ধারনা থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শুধুমাত্র অফিশিয়াল, অনুমোদিত পণ্য ক্রয় করা। যাতে পণ্যটির সঠিক মান এবং পরবর্তী সময়ে সেবা পাওয়া যায়। পণ্যের বৈশিষ্ট্য, মূল্য, ওয়ারেন্টি এবং বিক্রয়োত্তর সেবা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া উচিত। পণ্য ক্রয় করার সময় অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে ক্রয় করতে হবে, যাতে প্রতারণার শিকার না হন।

প্রযুক্তি পণ্য বিক্রয়ে বিক্রেতাদের করণীয়
দেশের সকল প্রযুক্তি পণ্য বিক্রেতাদের উচিত শুধুমাত্র অনুমোদিত এবং অফিসিয়াল পণ্য বিক্রি করা। মানহীন বা অবৈধভাবে আমদানিকৃত পণ্য বিক্রি করা উচিত নয়, কারণ এতে ক্রেতার আস্থা ও ভরসা হারাতে পারে এবং ব্র্যান্ডের সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে। প্রতিটি পণ্যের সঠিক তথ্য গ্রাহকদের সামনে তুলে ধরা এবং সঠিকভাবে মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। বিক্রয়ের পরেও বিক্রেতাদের উচিত গ্রাহকদের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করা।

আমদানিকারক ও পরিবেশকদের করণীয়:
আমদানিকারক ও পরিবেশকদের উচিত যথাযথভাবে ব্র্যান্ডের অনুমোদিত অফিসিয়াল পণ্য দেশে আনা এবং সঠিক চ্যানেলে পণ্য সরবরাহ করা। কোনোভাবেই মানহীন বা নকল পণ্য বাজারজাত করা উচিত নয়। তাদের আরও দায়িত্ব রয়েছে পণ্যের সঠিক গুণগত মান বজায় রাখা এবং দেশের বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এ ছাড়াও, তারা যেন প্রয়োজনীয় ওয়ারেন্টি এবং বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে সে বিষয়েও নিশ্চিত থাকতে হবে। আমদানিকারক ও পরিবেশকদের নকল পণ্য ক্রয় থেকে বিরত রাখার জন্য ক্রেতাদের সচেতন করতে হবে।

ওরিজিনাল ইক্যুপমেন্ট ম্যানুফেকচারার (OEM) প্রতিষ্ঠানগুলোর করণীয়
OEM প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো পণ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা। পণ্যের উন্নয়ন, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং বিতরণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা উচিত। এ ছাড়া, স্থানীয় বাজারের প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদা মাথায় রেখে পণ্য তৈরি করা এবং ব্র্যান্ডের সুনাম ধরে রাখা জরুরি। কোনো ধরনের মানহীন উপকরণ বা সেবা দেয়া OEM এর জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রযুক্তি পণ্য বাজারগুলোর করণীয়:
দেশে বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর ছাপিয়ে জেলায় জেলায় গড়ে ওঠেছে প্রযুক্তি পণ্যের বাজার। ঢাকার আগারগাঁওয়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি পণ্যের বিশেষায়িত বাজার বিসিএস কমপিউটার সিটি, ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে রয়েছে দেশের বৃহত্তম প্রযুক্তি পণ্যের বাজার ইসিএস কমপিউটার সিটি (মাল্টিপ্ল্যান কমপিউটার সিটি সেন্টার), ঢাকার মতিঝিলে রয়েছে গাউছে পাক কমপিউটার মার্কেট। এ ছাড়া শুধু ঢাকাতেই রয়েছে প্রায় ৪০টির বেশি প্রযুক্তি পণ্যের বাজার, দেশব্যাপী প্রায় শতাধিক হবে।

দেশের প্রযুক্তি পণ্যের বাজারগুলোতে অবশ্যই শুধুমাত্র অফিসিয়াল, অনুমোদিত পণ্য বিক্রি করতে হবে এবং সঠিকভাবে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করতে হবে। তারা যেন কোনো ধরনের অবৈধ বা মানহীন পণ্য বিক্রি না করে এবং পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে গ্রাহকদের সঠিক তথ্য প্রদান করে সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। তাদের আরও দায়িত্ব হলো বিক্রির পর গ্রাহকদের প্রয়োজনে বিক্রয়োত্তর সেবা দিতে প্রস্তুত থাকা। প্রতিটি বাজারে ক্রেতার স্বার্থ রক্ষায় অভিযোগ কমিটি গঠন করা উচিত। ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ে কোনো প্রকার সমস্যায় পড়লে সেই অভিযোগ কমিটি দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখতে পারে।

ক্রেতা পণ্য ক্রয় করে প্রতারিত হয়, সেক্ষেত্রে করণীয়:
যদি কোনো প্রযুক্তিপ্রেমী ক্রেতা পণ্য ক্রয়ে প্রতারিত হন, তাদের উচিত প্রথমেই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং পণ্যের রসিদ/বিল দেখিয়ে অভিযোগ জানানো। বিক্রেতা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া না পেলে, যে প্রযুক্তি পণ্যের বাজার থেকে পন্য ক্রয় করেছেন সেই বাজার কমিটির কাছে অভিযোগ করুন। যেহেতু বৃহত প্রতিটি প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে কার্য়নির্বাহী পরিষদ (ইসি) রয়েছে পাশাপাশি অভিযোগ দেয়ার জন্য আলাদা কমিটিও আছে।

সেখানে প্রতিকার না পেলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা উচিত। এর পাশাপাশি, পণ্যটি অফিসিয়াল না হলে, ভবিষ্যতে অনুমোদিত বা অথরাইজড বিক্রেতাদের থেকে পণ্য ক্রয়ের গুরুত্ব তুলে ধরা প্রয়োজন।

সার্ভিস ও ওয়ারেন্টি প্রাপ্তিতে করণীয়
পণ্যের ওয়ারেন্টি এবং বিক্রয়োত্তর সেবা নিশ্চিত করতে হলে, ক্রেতাদের উচিত পণ্য কেনার সময় নির্দিষ্ট দোকান বা বিক্রেতার কাছ থেকে সার্ভিস পলিসি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া। পণ্যটি কেনার পর ওয়ারেন্টি কার্ড বা অনলাইনে সিরিয়াল নম্বর রেজিস্ট্রেশন করে রাখা ভালো। কিউআর কোড স্ক্যান করে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওয়ারেন্টি প্রাপ্তি ও সেবা নিশ্চিত করা যাবে।

প্রযুক্তি পণ্য ক্রয় এবং বিক্রয়ের প্রতিটি ধাপে সততা, মান বজায় রাখা এবং ক্রেতার সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অনুমোদিত পণ্য ক্রয় এবং বিক্রয়োত্তর সেবা সম্পর্কে সচেতন থাকলে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। প্রযুক্তি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিটি স্তরে সততা এবং মান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা শুধু ক্রেতাদের নয়, সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যবসায়িক পরিবেশকে সুষ্ঠু ও নিরাপদ রাখবে।

লেখক: হাসান রিয়াজ (জিতু)- রিজিওনাল চ্যানেল ম্যানেজার, লেনোভো

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *