তারকা ও হাজারও নারীর মিলন মেলায় পরিণত উই সামিট
ক.বি.ডেস্ক: সারা দেশ থেকে আসা হাজারও নারীর পদচারণায় এক উদ্যোক্তা মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত উই সামিট ২০২৩। শুক্রবার সকাল থেকেই রাজধানীর কুড়িলের আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার বসুন্ধরায় দেশের বিভিন্ন জেলার নারীরা আসতে শুরু করেন। সকালেই মুখরিত হয়ে ওঠে প্রান্তিক ও শহুরে সব উদ্যোক্তা এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকাদের অংশগ্রহণে।
সকাল ১০টায় শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনের পর থেকেই অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য উদ্যোক্তাদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আয়োজিত প্যানেল আলোচনা ও কর্মশালা ছিল প্রাণবন্ত। হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা এসব সেশনে নিজেরে পাথেয় খুঁজে পান।
বর্ডারলেস বিজনেস: স্ট্রাটেজিস ফর ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স, লজিস্টিকস অ্যান্ড এক্সপোর্টিং
ক্রস বর্ডার ই-কমার্স সুবিধা পারে নারী উদ্যোক্তাদের বিশ্ব বাজারে পৌঁছে দিতে। ‘বর্ডারলেস বিজনেস: স্ট্রাটেজিস ফর ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স, লজিস্টিকস অ্যান্ড এক্সপোর্টিং’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উই’র উপদেষ্টা কবির সাকিবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইপিবি’র মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন আইস্যোসাল’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন্য রায়হান, দারাজ বাংলাদেশের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো এবং মার্কিন দূতাবাসের অর্থনৈতিক কর্মকর্তা জেমস গর্ডেনার।
মাহবুবুর রহমান বলেন, অনলাইন ব্যবসায় শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববাজার সকলের জন্যই উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের জন্যও ব্যবসায়ের একটি অবারিত দুয়ার খুলে গেছে। এর ফলে নারীর ক্ষমতায়নের পথও প্রশস্ত হয়েছে। এখন ঘরে বসেই হাতে তৈরি পণ্য বিভিন্ন ধরনের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমেরিকায় বিক্রি করা যাচ্ছে। আবার ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের প্রবাসীরা স্থানীয় অনলাইন থেকে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য পণ্য কিনে দিতে পারছেন। এটা আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। তাই এখনই আমাদেরকে ক্রস বর্ডার ই-কমার্স বিষয়ে শেখার বিষয়ে মনযোগী হতে হবে। কেননা বিশ্ববাজার সেদিকেই যাচ্ছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তারা যেন অনলাইনে তাদের পণ্য বিপণন করতে পারেন সেজন্য সহজ ও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও ওয়্যার হাউস সাপোর্টের পাশাপাশি পলিসি এবং পেমেন্টের সহজীকরণই পারে ক্রস-বর্ডার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, এমনটাই মনে করেন প্যানেল বক্তারা।
এমপাওয়ার থ্রু ইন্সপিরেশন: নার্সিং দ্য অন্ট্রাপ্রেনিউর মাইন্ড
প্যানেল আলোচনায় মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয়। প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুষমা রেজা, লেখক সাদাত রহমানসহ আরও অনেকে। আলোচনায় উদ্যোক্তাদের নানা মানসিক অবস্থার শিকারের কথা তুলে ধরে সেসব থেকে সুরক্ষার উপায় বলে দেয়া হয়।
দ্য ফেসবুক ফ্রন্টিয়ার: স্ট্র্যাটেজিস ফর ই-কমার্স গ্রোথ
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন এসআর ভেঞ্চারের প্রতিষ্ঠাতা সায়মা রহমান, ডান ও ব্র্যান্ডস্ট্রিট ডেটার সিইও জারা মাহবুব, এসএসএল কমার্সের সিওও ইফতেখার ইসাহাক, বারকোড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মনজুরুল হক। প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করেন ট্রেইনার অথর আলতামিস নাবিল।
ফেসবুক অনলাইন ব্যবসার অন্যতম একটি মাধ্যম। এই মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে অনেকে নানা ধরনের অসুবিধায় পড়েন। সেসব বিষয় উঠে আসে এই আলোচনায়। এ ছাড়া এই সময়ে ডেটা, ডেটার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেন আলোচকরা।
ডিজিটাল ডায়নামো: ইনহ্যান্সিং ডিজিটাল স্কিলস ফর বিজনেস এক্সিলেন্স
প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের হেড অব ডিজিটাল তাজদিন হাসান, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট হওসনা ফেরদৗস সুমি, এজ প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন। অনলাইন ব্যবসায়ের জন্য যেসব ডিজিটাল স্কিলস প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। উঠে আসে নারী উদ্যোক্তাদের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথাগুলো।
শিল্ডিং দ্য ডিজিটাল রিলেম: ইনসাইট ইনটু ডিজিটাল কানেক্টিভিটি অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি
প্যানেল আলোচনায় অন্যতম বিষয় ছিল সম্প্রতি ফেসবুক থেকে হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু বড় গ্রুপ। এ ছাড়া সাইবার সিকিউরিটির বিষয়গুলোও উঠে আসে আলোচনায়।
ডিএমপি’র সাইবার সিকিউরিটি বিভাগে এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল মাধ্যম সুরক্ষা রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করছে। বর্তমানে মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কনটেন্টসহ ফেসবুক পেজ হারিয়ে যাচ্ছে। যা একজন ডিজিটাল ব্যবসায়ীর জন্য ক্ষতিকারক। তাই এ বিষয় নিয়ে ফেসবুকের সঙ্গে কথা বলবো। যাতে করে তারা সহজে ব্যবসা করতে পারে। বাংলাদেশ পুলিশের ৫টি ইউনিট সাইবার নিরাপত্তায় কাজ করছে। বর্তমান সময়ে ওটিপি শেয়ারের মাধ্যমে সাইবার হামলার শিকার বেশি হচ্ছে। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
আইসিটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেয়া হবে ২৫ হাজার নারীদের। ৬ মাসের এই প্রশিক্ষণে প্রত্যেককে একটি ল্যাপটপ দেয়া হবে। বর্তমান সরকার নারীদের ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে আগ্রহী করে তুলতে কাজ করছে।
প্রধান অতিথি বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, নারীদের প্রযুক্তি খাতে আগ্রহী করে তুলতে বিটিআরসি নানা ধরনের পলিসি নিয়ে কাজ করে থাকে। নারীরা যাতে এই সেক্টরে এগিয়ে আসতে পারে তার জন্য শহরের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামেও কমদামে ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছি আমরা। ফেসবুকের কনটেন্ট সমস্যা হয়, প্রায় সময় আমরা এই বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলি। সামনের দিনেও বলব।
এ ছাড়াও আলোচনায় অনলাইনে যোগ দিয়ে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কথা বলেন সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা।
লার্নস ওয়েলের মাস্টার ক্লাস
উই সামিট ২০২৩ এ একটি মাস্টারক্লাস কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালা পরিচালনা করেন লার্নস ওয়েলের বাংলাদেশের কর্মকর্তা আদিলা সাঈদ।
আদিলা সাঈদ বলেন, এখন অনলাইনে ব্যবসা করতে গেলে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয় সেটি হলো সাইবার সিকিউরিটি। সাইবার সিকিউরিটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে তাদের প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লার্নস ওয়েল। বাংলাদেশ থেকে উদ্যোক্তারা সে সেবা সহজেই নিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে বাড়াতে পারবেন।
নারীর হাইজিন
নারীদের হাইজিন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মণিকা রহমান। তিনি নারীদের মেনস্ট্রুশেন থেকে অন্য সব শারিরীক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কিশোরী ও নারীদের হাইজিন যথাযথভাবে মেনে চলার অনুরোধ জানান।
আয়মান সাদিকের সেশন
টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আয়মান সাদিক শুরু করেন তার সংক্ষিপ্ত সেশন। এই সেশনে তিনি উই-এর নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের অনুপ্রেরণার গল্প তুলে ধরেন। এ সময় তিনি উদ্যোক্তাদের জন্য চারটি বিষয় তুলে ধরে সেগুলো নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। প্রথম অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ দেয়া, প্রয়োজনীয় কাজগুলোকে অটোমেশন করা, সেগুলোকে ডেডিকেট করে তা অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে এবং সবশেষ নিজেকে এগিয়ে নিতে প্রাধান্য দেয়া। এসব বিষয় মেনে চললে সামনে দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাধা এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে বলে জানান।
ছিল তারকাদের মিলনমেলাও
উই সামিট ২০২৩ এর প্রথম দিনে ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকাদের মিলনমেলাও। সারা দেশ থেকে আসা নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র তারকা ও এজে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী অন্তত জলিল।
অন্তত জলিল বলেন, আমি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। আজ উই সামিটে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার সামনে কথা বলছি, এটা অন্য রকম অনুভূতি। এই ছোট অবস্থান থেকেই আপনারাও একসময় দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী হিসেবে উঠে আসবেন বলে আমি প্রত্যাশা করি।
এ ছাড়া দিনের সর্বশেষ প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন আফসান আরা বিন্দু, রুনা খান, জাকিয়া বারী মম, মাসুমা রহমান নাবিলাসহ অন্যরা। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে।
উই সামিট ২০২৩-এর দ্বিতীয় দিন শনিবার (৭ অক্টোবর) দুপুর ২টায় শুরু হবে দিনের কর্মসূচি। এরপর অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য, কর্মশালা, বিকেল সাড়ে ৪টার থেকে প্যানেল আলোচনা এবং সন্ধ্যায় থাকছে ২০ নারী উদ্যোক্তাকে ‘জয়ী অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান। আর সমাপনী অনুষ্ঠান হবে একটি ফ্যাশন শো’র মাধ্যমে।