প্রতিবেদন

ডেটা সার্বভৌমত্বের সূচনা: নাগরিক তথ্য এখন নিরাপদ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষার জন্য ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এবং উপাত্ত ব্যবস্থাপনার জন্য ‘জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃপরিচালন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এটি কেবল একটি আইনি দলিল নয়, বরং দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের জন্য এক ঐতিহাসিক বিজয় এবং ডেটা গভর্নেন্সের ক্ষেত্রে এক নতুন, শক্তিশালী ও জবাবদিহিতামূলক অধ্যায়ের সূচনা।

গত ৬ নভেম্বর, ২০২৫ গেজেট আকারে প্রকাশিত (জারি) হয়েছে এবং ‘জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃপরিচালন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “আমরা প্রমাণ করেছি আমরা পারি, বাংলাদেশ পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিআর (জিডিপিআর)- এর এক দশক পরে হলেও, আমরা পেরেছি। ডেটা গভর্নেন্সের এই সূচনা বিন্দুতে আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধান উপদেষ্টাকে।”

আইনের আগে ডেটা সুরক্ষার অরক্ষিত ও অপব্যবহারের প্রেক্ষাপট
এই যুগান্তকারী আইন আসার আগে বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত উপাত্ত ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত এবং এক আইনি শূন্যতার শিকার। এই অরক্ষিত অবস্থার সুযোগ নিয়ে দেশের কিছু প্রভাবশালী স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম এবং সংস্থাগুলো যে দুর্বৃত্তপনা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ঘোরতর লঙ্ঘন, নিরাপত্তাহীনতা এবং ডার্ক ওয়েবে ব্যক্তিগত ডেটা বিক্রির যে অপব্যবহার বাংলাদেশে তৈরি করেছিল, আজ থেকে তার কবর রচিত হলো। ব্যক্তিগত তথ্যের যথেচ্ছ ব্যবহার, ডেটা বিক্রি করার বদমাইশি এবং জবাবদিহিতাহীন আদান-প্রদান ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

নতুন আইনের নিশ্চয়তা: ব্যক্তির অধিকার ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব
নতুন ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ায় বাংলাদেশের নাগরিকরা এখন আইনিভাবে নিশ্চিত হতে পারে যে তাদের উপাত্ত সুরক্ষিত হবে। এই আইন নিম্নলিখিত শক্তিশালী নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করেছে-

ব্যক্তির মালিকানা ও সম্মতি: আইনটি প্রতিষ্ঠা করে যে ব্যক্তিগত উপাত্তের মালিকানা উপাত্তধারীর (ডেটা সাবজেক্ট)। উপাত্ত-জিম্মাদারকে অবশ্যই উপাত্তধারীর সুস্পষ্ট ও স্বেচ্ছামূলক সম্মতির ভিত্তিতে তথ্য প্রক্রিয়া করতে হবে।

সংবেদনশীল তথ্যের উচ্চ সুরক্ষা: আইনটি স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয়, জেনেটিক, বায়োমেট্রিক এবং অপরাধ সংক্রান্ত উপাত্তকে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত উপাত্ত হিসেবে চিহ্নিত করে এর প্রক্রিয়াকরণের জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করেছে।

উপাত্তের শ্রেণিবিন্যাস: সরকার উপাত্তকে (ক) উন্মুক্ত, (খ) অভ্যন্তরীণ, (গ) গোপনীয়, ও (ঘ) সীমাবদ্ধ এই চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে, যা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনবে।

প্লাটফর্ম লায়াবিলিটি ও ডেটা সার্বভৌমত্ব: উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিনিময় এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে কঠোর আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইন লঙ্ঘিত হলে নাগরিকরা প্রতিকার চাইতে পারবেন এবং বাংলাদেশের ডেটা সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করে আর কেউ ডিজিটাল ব্যবসা করতে পারবে না।

বৈশ্বিক মানদণ্ড ও যৌক্তিকতা
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এই আইন প্রণয়ন অত্যন্ত যৌক্তিক ও অপরিহার্য পদক্ষেপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিআর, ভারতের ডিজিটাল ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন এবং ব্রাজিলের এলজিপিডি-এর মতো আইনগুলো বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ডেটা সুরক্ষা নীতিমালার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করল।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ
‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’- এর অধীনে গঠিতব্য বাংলাদেশ উপাত্ত সুরক্ষা বোর্ড এই আইনের সফলতার কেন্দ্রবিন্দু। এই স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইন প্রয়োগ ও তত্ত্বাবধান করবে, অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে এবং সময়োপযোগী নীতিমালা তৈরি করবে।

বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, আইন প্রণয়ন একটি সূচনা মাত্র। তবে, ধারা ২৪ অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা অপরাধ প্রতিরোধের মতো অস্পষ্ট কারণ দেখিয়ে উপাত্ত সংগ্রহে সম্মতির প্রয়োজন না থাকার বিধানটি অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর মূল সফলতা নির্ভর করবে ‘বাংলাদেশ উপাত্ত সুরক্ষা বোর্ডের’ নিরপেক্ষতা, আর্থিক স্বাধীনতা এবং প্রযুক্তি-নির্ভর প্রয়োগ ক্ষমতার ওপর।

বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো আধুনিকায়ন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রয়োগ।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “ডেটা গভর্নেন্স আইন থামাতে, ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন বন্ধ করতে আমাদের এসব কাজকে ডিলিজিটিমেট করতে দেশ-বিদেশ থেকে সংঘবদ্ধভাবে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। এজন্য আমাকে এবং আমার টিমকে প্রচণ্ড রকম যুদ্ধ করতে হয়েছে, অনেক যন্ত্রণা দেয়া হয়েছে এবং অপবাদ দেয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা সেগুলোতে থেমে যাইনি।”

তিনি আরও বলেন, “এই আইনের ফলে ব্যক্তিগত ডেটা বিক্রি এবং ডেটা নিয়ে অবৈধ ব্যবসার সুযোগ আর রইল না। অত্যন্ত শক্তিশালী এক মোরাল নিয়ে আমরা যে কাজ করছি, এটি তাদের আবারও প্রমাণ করে ছেড়েছি। এখন থেকে, ব্যক্তির তথ্য উপাত্ত নিয়ে জবাবদিহিতাহীন আদান-প্রদান এবং অবৈধ ব্যাবসা আইনিভাবে রহিত হলো। প্ল্যাটফর্‌ম সমূহের যৌক্তিক আচরণের অধ্যায়ও শুরু হলো।”

ডেটা গভর্নেন্স এর নতুন যুগে সবাইকে স্বাগতম!
আইনটিকে সফল করতে, প্রতিটি নাগরিককে তাদের ডেটা সুরক্ষা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং উপাত্ত সুরক্ষা বোর্ডকে সহযোগিতা করতে হবে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *