ডিবিআইডি: লক্ষ উদ্যোক্তার স্বপ্ন, হাজার আবেদনের ভোগান্তি

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ডিজিটাল রুপান্তরে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই ডিজিটাল বিপ্লবে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে ‘ডিজিটাল বিজনেস আইডি’ (ডিবিআইডি)। এটি ডিজিটাল কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি পদক্ষেপ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০২০-এর অধীনে ডিবিআইডি সিস্টেমটি ২০২১ সালের শুরুর দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত কয়েক হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ডিবিআইডি নিবন্ধন করেছেন।
ডিবিআইডি কেন গুরুত্বপূর্ণ: আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ড
ডিবিআইডি হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন আরজেএসসি থেকে ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের জন্য দেয়া একটি একক শনাক্তকরণ নম্বর। এটি ট্রেড লাইসেন্সের ডিজিটাল সংস্করণ, যা ব্যবসার বৈধতা নিশ্চিত করে।
একজন সফল অনলাইন উদ্যোক্তা বলেন ‘ডিবিআইডি পাওয়ার পর আমার ব্যবসার বিক্রি ৩০ শতাংশ বেড়েছে কারণ ক্রেতারা এখন আমাকে আরও বেশি বিশ্বাস করে।’
একজন অনলাইন ক্রেতা বলেন, ‘আমি এখন কোনও ফেসবুক পেজ থেকে কেনার আগে ডিবিআইডি নম্বর আছে কিনা তা যাচাই করে নেই।’
ডিবিআইডি নিবন্ধনের চ্যালেঞ্জ: মূল সমস্যা কোথায়
ডিবিআইডি নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজ মনে হলেও, লক্ষ লক্ষ উদ্যোক্তার তুলনায় এর গ্রহণ সংখ্যা খুবই কম। এই সমস্যার পেছনে উদ্যোক্তা এবং ডিবিআইডি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের উভয়ের দুর্বলতা রয়েছে।
উদ্যোক্তাদের দিক থেকে
সচেতনতার অভাব: দেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার, বিশেষ করে যারা ফেসবুক বা ছোট প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করেন, তাদের মধ্যে ডিবিআইডি সম্পর্কে কোনও সচেতনতাই নেই।
ডিজিটাল নিরক্ষরতা ও ভীতি: অনলাইনে ফর্ম পূরণ, কাগজপত্র স্ক্যান ও আপলোড করা এবং পেমেন্ট করার মতো কাজগুলো অনেক উদ্যোক্তার জন্য কঠিন।
ট্যাক্স ও আমলাতান্ত্রিক ভীতি: অনেকে মনে করেন, ডিবিআইডি করলে সরকারি নজরদারি ও করের (ভ্যাট ও টিআইএন) আওতায় আসবেন।
ডিবিআইডি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের (আরজেএসসি) দিক থেকে
জনবল ও রিসোর্সের অভাব: আরজেএসসি একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রতিষ্ঠান, যার সীমিত জনবল বিশাল সংখ্যক আবেদন সামলাতে অপারগ। ফলে হাজার হাজার আবেদন জমে থাকে এবং প্রক্রিয়াকরণ বিলম্বিত হয়।
প্রশাসনিক দুর্বলতা: ডিবিআইডি আবেদন অনলাইনে হলেও, অনুমোদন প্রক্রিয়াটি এখনও পুরনো ম্যানুয়াল পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। এটি একটি ডিজিটাল মুখোশ-এর আড়ালে থাকা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার উদাহরণ।
সেবামূলক মানসিকতার অভাব: আরজেএসসি-এর পক্ষ থেকে সেই মানসিকতার অভাব স্পষ্ট। আবেদনকারীরা সমস্যায় পড়লে কোনও কার্যকর হেল্পলাইন বা দ্রুত উত্তর দেয়ার ব্যবস্থা নেই।
এটুআই-এর সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও জটিলতা: ডিবিআইডি সিস্টেমের প্রযুক্তিগত ডিজাইন ও বাস্তবায়নে এটুআই-এর মতো বিশেষায়িত সংস্থা কাজ করেছে। এটুআই, যা আইসিটি বিভাগের অধীনে, তারা মাইগভ, একশপ-এর মতো বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা তৈরি করেছে। এমন কারিগরি সহায়তা সত্ত্বেও প্রক্রিয়া সহজ না হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা ও বাস্তবায়নে দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে।
একটি বাস্তব গল্প: শাহিদা বেগমের সফলতার সিঁড়ি
রংপুরের এক গ্রাম থেকে ফেসবুকে শাড়ির ব্যবসা শুরু করেন শাহিদা বেগম। শুরুতে ক্রেতার আস্থা অর্জন করতে পারছিলেন না। যখন তিনি ডিবিআইডি নিবন্ধন করেন, তার ব্যবসার মোড় ঘুরে যায়। ডিবিআইডি নম্বরটি পেজে যুক্ত করার পর ক্রেতাদের আস্থা বেড়ে যায় এবং তার বিক্রি ৫০ শতাংশ বাড়ে। ডিবিআইডি-এর মাধ্যমে তিনি শুধু বিশ্বাসই অর্জন করেননি, বরং একটি ব্যাংক থেকে ঋণও পেয়েছেন, যা দিয়ে তিনি ব্যবসার পরিধি আরও বড় করেছেন।

ডিবিআইডি না থাকলে কি ব্যবসা করা যাবে
ডিবিআইডি না থাকলেও ব্যবসা করা যায়। বর্তমানে বহু ছোট অনলাইন ব্যবসা ডিবিআইডি ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। তবে, এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
ডিবিআইডি না থাকলে অসুবিধা
ক্রেতার আস্থার অভাব: ডিবিআইডি-নিবন্ধিত না হলে ক্রেতারা প্রায়শই বিক্রেতাকে বিশ্বাস করতে পারেন না।
পেমেন্ট গেটওয়ে পেতে বাধা: অনেক পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানি ঝুঁকি কমাতে ডিবিআইডি ছাড়া নতুন গ্রাহকদের অনুমোদন দেয় না।
অর্থনৈতিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত: ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে ডিবিআইডি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
আইনি জটিলতা: কোনও বিরোধ দেখা দিলে, ডিবিআইডি না থাকলে আইনি সুরক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
ডিবিআইডি-এর ভবিষ্যৎ ও সরকারের প্রতি সুপারিশ
ডিবিআইডি বাংলাদেশের ডিজিটাল কমার্স খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ভবিষ্যতে ডিবিআইডি-এর সঙ্গে ই-টিআইএন এবং ভ্যাট নিবন্ধনের সমন্বয় সাধন করা গেলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি কাঠামো তৈরি করবে।
একজন প্রযুক্তি বিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞের মতে, ‘ডিবিআইডি একটি ডিজিটাল সনদ। ভবিষ্যতে এটি ডিজিটাল লেনদেনের আইনি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে এবং অনলাইন প্রতারণা রোধে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এটি শুধু একটি পরিচয়পত্র নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই ডিজিটাল ব্যবসার ভিত্তি।’
সরকারের প্রতি সুপারিশ
কৌশলগত প্রচার: ডিবিআইডি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করা।
প্রক্রিয়া সরলীকরণ: নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে মোবাইল অ্যাপ বা স্থানীয় সহায়তা কেন্দ্র চালু করা।
অধিক সহায়তা: নিবন্ধিত উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ, সরকারি অনুদান এবং প্রশিক্ষণের মতো বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করা।
আন্তঃ-প্রাতিষ্ঠানিক ডেটা বিনিময়ের মডেল: ই-ক্যাবের মতো বাণিজ্য অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গে আরজেএসসি একটি সমন্বিত ডিজিটাল সিস্টেম চালু করতে পারে। এতে একই কাগজপত্র দুইবার জমা দেয়ার ভোগান্তি দূর হবে।
প্রতিকার: কার কাছে যাওয়া হবে
ডিবিআইডি প্রদানে বিলম্ব বা কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে উদ্যোক্তাদের কার কাছে যাওয়া উচিত, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যেহেতু আরজেএসসি-এর কাছে সরাসরি প্রতিকার চাওয়া কঠিন, তাই কিছু বিকল্প পথ অনুসরণ করা যেতে পারে-
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়: ডিবিআইডি সরাসরি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি উদ্যোগ। আরজেএসসি-এর কার্যক্রমে কোনও বড় ধরনের প্রশাসনিক জটিলতা দেখা গেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে লিখিত অভিযোগ জানানো যেতে পারে।
ই-ক্যাব এবং অন্যান্য অ্যাসোসিয়েশন: একজন একক উদ্যোক্তার চেয়ে একটি অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সম্মিলিত অভিযোগের গুরুত্ব অনেক বেশি। ই-ক্যাবের মতো সংগঠনগুলো উদ্যোক্তাদের পক্ষে সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করতে পারে।
সামাজিক মাধ্যম: ডিজিটাল যুগে সামাজিক মাধ্যম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ডিবিআইডি প্রক্রিয়া নিয়ে সমস্যাগুলো বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরলে তা কর্তৃপক্ষের ওপর দ্রুত সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ডিবিআইডি-কে জটিল না ভেবে, এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এর মাধ্যমে কেবল ব্যবসার বৈধতা নিশ্চিত হয় না, বরং এটি ক্রেতার আস্থা অর্জন এবং নিজেদের ব্যবসাকে একটি টেকসই কাঠামোতে দাঁড় করানোর জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার। এটি অনেকটা লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর মতো। আপনি চালাতে পারেন, কিন্তু যেকোনও সময় আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব