প্রতিবেদন

ক্রাউড ফান্ডিং: বিনিয়োগের সম্ভাবনা, আইনি শূন্যতায় প্রতারণার ফাঁদ?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে ক্রাউড ফান্ডিং (Crowdfunding) বা গণ-অর্থায়ন একটি বৈপ্লবিক অর্থায়ন মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই প্রক্রিয়ায় একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে স্বল্প স্বল্প পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করে কোনও নতুন ব্যবসা, স্টার্টআপ বা সৃজনশীল প্রকল্পের জন্য তহবিল জোগাড় করা হয়। বাংলাদেশেও অনেকে নিজেদের ব্যবসার জন্য এই পথে হাঁটছেন, আবার অনেকেই এতে বিনিয়োগ করে বিপদে পড়ছেন, রিস্ক নিচ্ছেন এবং প্রতারিতও হচ্ছেন।

বর্তমানে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা, উপযোগিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা একটি গুরুতর প্রশ্নের মুখে। ক্রাউড ফান্ডিং পদ্ধতিটি তার মূলগত দিক থেকে একটি বৈধ বিনিয়োগের মাধ্যম, যা নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এর জন্য সুনির্দিষ্ট আইন বা নিয়ন্ত্রক কাঠামো না থাকায়, এটিকে স্ক্যাম বা প্রতারণার মাধ্যমে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের চিত্র ও নির্ভরশীলতা
বাংলাদেশে আধুনিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম-ভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিংয়ের সূচনা হয়েছে ২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘প্রজেক্ট ডটকম’ এবং ‘বাংলা ফান্ডিং ডট কম’-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে এই ধারণাটি পরিচিতি পায়। উল্লেখ্য, এই প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রাউড ফান্ডিংয়ের প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে তখন চালু ছিল, তবে বর্তমানে এগুলো সক্রিয়ভাবে চলমান আছে কি না তা নিশ্চিত নয়।

বর্তমানে নির্ভরশীল প্রধান ব্যবসায়িক সেক্টরসমূহ
যেহেতু বাংলাদেশে পুঁজি-ভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিং বৈধ নয়, বর্তমানে উদ্যোক্তারা অনুদান ও পুরস্কার-ভিত্তিক মডেলের মাধ্যমে সীমিত অর্থায়নের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবসায়িক সেক্টরগুলোতে নির্ভর করছেন-

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: হার্ডওয়্যার স্টার্টআপগুলো পণ্যের প্রোটোটাইপ বা প্রথম ব্যাচের উৎপাদন এবং অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপাররা নতুন সফটওয়্যার বা অ্যাপের প্রাথমিক কোডিং এর খরচ মেটাতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

অনলাইন ও ই-কমার্স উদ্যোগ: ছোট ই-কমার্স ব্যবসাগুলো যখন একটি সম্পূর্ণ নতুন পণ্য লাইন বা সিরিজ বাজারে আনতে চায় বা তাদের প্ল্যাটফর্মের আঞ্চলিক সম্প্রসারণ ঘটাতে চায়, তখন এই অর্থায়ন মডেলের সাহায্য নেয়।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প: ফুড টেক স্টার্টআপ, বিশেষায়িত ম্যানুফ্যাকচারিং এবং হস্তশিল্প উদ্যোগগুলো কাঁচামাল কেনা বা নতুন যন্ত্রপাতি কেনার প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহের জন্য এই পথ বেছে নেয়।

পরিসংখ্যান ও সীমাবদ্ধতা
আর্থিক চিত্র: পুঁজি-ভিত্তিক বা ঋণ-ভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিংয়ের জন্য অনুমোদিত প্ল্যাটফর্ম না থাকায়, ব্যবসার অর্থায়নে এই পদ্ধতি ব্যবহারের আর্থিক পরিসংখ্যান নগণ্য, যা শতাংশের দিক থেকে প্রায় ০ শতাংশ। এর বিপরীতে, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে, বাংলাদেশী স্টার্টআপগুলো ২২টি ডিলে ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল সংগ্রহ করেছে।

ব্যবহারকারী উদ্যোক্তা: ক্রাউড ফান্ডিংয়ের প্রতি আগ্রহ নবীন স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের মধ্যেই বেশি, কারণ তাদের প্রচলিত অর্থায়ন পেতে কষ্ট হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের প্রায় ৮৮.৬ শতাংশ এর ক্রাউড ফান্ডিং ব্যবহারের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগ: ‘লুকানো ক্রাউড ফান্ডিং’ ও তার ঝুঁকি
আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম বা নিয়ন্ত্রক কাঠামোর বাইরে, বাংলাদেশে আরও এক ধরনের ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ প্রচলিত আছে, যাকে ‘লুকানো ক্রাউড ফান্ডিং’ বা অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক বিনিয়োগ বলা যায়। পরিসংখ্যানিক তথ্য-উপাত্তে এর উল্লেখ না থাকলেও, ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই বিনিয়োগগুলো ব্যাপকভাবে ঘটছে। এই অনানুষ্ঠানিক বিনিয়োগের ধরণগুলো সাধারণত নিম্নরূপ-

ব্যক্তি-থেকে-ব্যক্তি বা নেটওয়ার্ক ফান্ডিং: একজন উদ্যোক্তা তার বন্ধু, পরিবার, পরিচিত মহল বা পেশাগত নেটওয়ার্কের একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে স্বল্প বা মাঝারি অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেন। এটি কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে না হয়ে ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা মৌখিক প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে।

ব্যক্তি-থেকে-প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান-থেকে-প্রতিষ্ঠান: অনেক সময় কোনও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান তাদের সম্প্রসারণের জন্য বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ছোট ছোট স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বা ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে যৌথভাবে পুঁজি সংগ্রহ করে।

যেহেতু এই লেনদেনগুলো কোথাও লিপিবদ্ধ হয় না, সেহেতু এদের রিক্স ফ্যাক্টরগুলো অত্যন্ত উচ্চ। এখানে বিনিয়োগকারী আইনি সুরক্ষার সর্বনিম্ন স্তরটুকুও পান না এবং কমিটমেন্ট অনুযায়ী লাভ বা মূলধন ফেরত না পেলে তা প্রমাণের সুযোগও সীমিত থাকে। এই লুকানো বিনিয়োগগুলোই প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ঝুঁকি ফ্যাক্টর, আইনি অবস্থান ও প্রতিকার
বাংলাদেশে আইনি শূন্যতা এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবই ক্রাউড ফান্ডিংয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে।
আইনি অবস্থান ও রিক্স ফ্যাক্টর
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য পুঁজি-ভিত্তিক বা ঋণ-ভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিং সরাসরি বৈধ বা নিয়ন্ত্রিত নয়, এটি আইনি শূন্যতার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) কর্তৃক সুনির্দিষ্ট কোনও আইন বা লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া নেই। এই আইনি শূন্যতার কারণে প্রধান রিক্স ফ্যাক্টরগুলো হলো-
প্রতারণার ঝুঁকি: উদ্যোক্তারা মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং কমিটমেন্ট অনুযায়ী বিনিয়োগের অর্থ বা লাভ ফেরত দেন না, যা প্রতারণার জন্ম দেয়।
তারল্যের অভাব: বিনিয়োগের অর্থ সহজে তুলে নেওয়া বা শেয়ার বিক্রি করা যায় না।
স্বচ্ছতার অভাব: তহবিল সংগ্রহকারী ব্যবসার আর্থিক অবস্থা এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে কোনো বাধ্যতামূলক তথ্য প্রকাশ করা হয় না।

প্রতারিত হলে আইনি ব্যবস্থা
যে কোনও পক্ষই (উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী) কমিটমেন্ট অনুযায়ী কার্যকারিতা না রাখলে বা প্রতারিত হলে, তারা প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে পারেন-
ফৌজদারি মামলা (প্রতারণা): বিনিয়োগকারী দণ্ডবিধি (Penal Code), ১৮৬০ অনুযায়ী প্রতারণা (ধারা ৪২০) বা বিশ্বাসভঙ্গ (ধারা ৪০৬) এর জন্য মামলা দায়ের করতে পারেন।
দেওয়ানি মামলা (চুক্তি ভঙ্গ): চুক্তিপত্রের শর্তাবলী পালন না হলে চুক্তি আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী চুক্তির ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করা যেতে পারে।
জরুরী অভিযোগ: প্রতারিত হলে দ্রুততম সময়ে থানা, সিআইডি বা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এর কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা জরুরি।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা
আন্তর্জাতিকভাবে ক্রাউড ফান্ডিং একটি নিয়ন্ত্রিত ও শক্তিশালী খাত। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ক্রাউড ফান্ডিং বাজারের আকার ১৭.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার-এ পৌঁছেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। এই মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি-

নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রণয়ন: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর তত্ত্বাবধানে পুঁজি ও ঋণ-ভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা আবশ্যক।
বিনিয়োগ সীমা ও সুরক্ষা: সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দিতে হবে।
এসক্রো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার: সংগৃহীত তহবিল সরাসরি উদ্যোক্তার কাছে না দিয়ে একটি তৃতীয় পক্ষের নিয়ন্ত্রিত এসক্রো অ্যাকাউন্ট (Escrow Account)-এ রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে প্রকল্পের মাইলফলক অর্জনের পর ধাপে ধাপে অর্থ ছাড় করা যায়।
বাধ্যতামূলক তথ্য প্রকাশ: প্ল্যাটফর্মগুলোকে তহবিল সংগ্রহকারী ব্যবসার ঝুঁকি, আর্থিক বিবরণী এবং অর্থের ব্যবহার সম্পর্কে সকল তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ করতে হবে।

ক্রাউড ফান্ডিং একটি শক্তিশালী আর্থিক প্রক্রিয়া। তবে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অনুপস্থিতিই এটিকে বিনিয়োগের সুযোগের চেয়ে প্রতারণার ফাঁদে পরিণত করার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করতে দ্রুত ও কার্যকর সরকারি নীতিমালা প্রণয়নই বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *