প্রতিবেদন

কোটি টাকার বাজার: এফ-কমার্স কি বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন ঠিকানা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল ই-কমার্স খাতের একটি প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে এফ-কমার্স বা ফেসবুক কমার্স। এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক মাধ্যম নয়, বরং অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।

জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণ
এফ-কমার্স প্রচলিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের চেয়ে অধিক জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। একটি ওয়েবসাইট তৈরি, ডোমেইন কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর বিপরীতে, এফ-কমার্সে শুধুমাত্র একটি ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ খুলে বিনা খরচে ব্যবসা শুরু করা যায়। এটি নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রবেশাধিকার সহজ করেছে।

এফ-কমার্সে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ হয় মেসেঞ্জার, লাইভ ভিডিও এবং কমেন্টের মাধ্যমে। এই ব্যক্তিগত এবং তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ক্রেতাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করে। লাইভ ভিডিওতে বিক্রেতারা পণ্যের মান, আকার ও ব্যবহার সরাসরি দেখান, যা ক্রেতাদের সঙ্গে এক ধরনের মানবিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়। এ ছাড়াও, প্রচলিত ই-কমার্সের মতো রেজিস্ট্রেশন বা একাধিক ধাপের পরিবর্তে এফ-কমার্সে ক্রেতা শুধু একটি মেসেজের মাধ্যমে অর্ডার সম্পন্ন করতে পারেন। এটি কেনাকাটাকে সহজ ও ঝামেলামুক্ত করে।

অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ আসে এফ-কমার্স থেকে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার এই বাজারের মধ্যে এফ-কমার্সের অবদান ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই খাতটি দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বর্তমানে প্রায় ৩ থেকে ৫ লক্ষ উদ্যোক্তা এফ-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত, যাদের মধ্যে ৬৫-৭০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা। তারা ঘরে বসে পোশাক, হস্তশিল্প, এবং ঐতিহ্যবাহী খাদ্যদ্রব্যের মতো পণ্য বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এই খাতটি ডেলিভারি পার্টনার, ফটোগ্রাফার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।

সাফল্যের গল্প: অনেক নারী উদ্যোক্তা, যেমন- উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) গ্রুপের সদস্যরা, ফেসবুককে ব্যবহার করে সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করলে ক্ষুদ্র পরিসরেও বড় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার
এফ-কমার্স খাতের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট এবং আইনি কাঠামোর অভাব। কিছু অসাধু বিক্রেতার কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই প্রতারণার শিকার হন।
ক্রেতার প্রতারিত হওয়ার দিক: ক্রেতারা অনেক সময় ভুল, নিম্নমানের বা সম্পূর্ণ ভিন্ন পণ্য পান। বিক্রেতা টাকা নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যেতে পারে।

উদ্যোক্তার প্রতারিত হওয়ার দিক: উদ্যোক্তারাও নকল বা ভুল ঠিকানা দিয়ে করা অর্ডারের কারণে ডেলিভারি ও পণ্যের ক্ষতির শিকার হন। আইনি ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় তাদের পক্ষে কোনও ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যা সমাধানে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই সচেতনতা জরুরি। একই সঙ্গে, সরকারের উচিত একটি কার্যকর নিবন্ধন ব্যবস্থা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা তৈরি করা।

এফ-কমার্স পরিচালনায় ব্যয়
এফ-কমার্স পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের কিছু নির্দিষ্ট খাতে অর্থ ব্যয় করতে হয়। যেমন- আয়ের প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ফেসবুক বিজ্ঞাপনে খরচ হয়, যা গ্রাহক টানতে জরুরি। মোট ব্যয়ের প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ ডেলিভারি ও লজিস্টিক্সে খরচ হয়। প্রমোশনের জন্য পেশাদার ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি বা ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়েও ব্যয় করতে হয়। বেশিরভাগ উদ্যোক্তার কোনও স্থায়ী শোরুম বা অফিস থাকে না। প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ উদ্যোক্তা তাদের বাসা থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করেন, যা খরচ কমিয়ে দেয়।

শক্তি, দুর্বলতা, সুযোগ এবং হুমকি বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক আলোচনা

শক্তি- সহজে শুরু করা, খরচ কম, সরাসরি গ্রাহক সম্পর্ক। দুর্বলতা- নিয়ন্ত্রণের অভাব, আস্থার সংকট, অনিরাপদ লেনদেন। সুযোগ- গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রসার, নারী কর্মসংস্থান, প্রযুক্তির উন্নয়ন। হুমকি- প্রতারণার ঝুঁকি, অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা, আইনি অস্পষ্টতা।

ভবিষ্যতের পূর্বাভাস এবং আরও গভীর বিশ্লেষণ
এফ-কমার্সকে একটি নিয়মতান্ত্রিক আইনি কাঠামোর আওতায় আনা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে, এই অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে কর আদায় একটি জটিল বিষয়। সরকারের এমন একটি কর ব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে। এ ছাড়াও, শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার পার্থক্য এই খাতের প্রসারে বাধা সৃষ্টি করছে। গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সহজলভ্য ইন্টারনেট অবকাঠামো প্রয়োজন। তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে অনেক সময় অস্বাভাবিক কম মূল্য এবং পণ্যের মানের সঙ্গে আপস করার প্রবণতাও দেখা যায়।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এফ-কমার্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এটি কেবল পণ্য কেনা-বেচার একটি প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক শক্তিশালী ইঞ্জিন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই খাতটি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা পায়, তবে এটি বেকারত্ব দূরীকরণ, নারী ক্ষমতায়ন এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর)-এর মতো প্রযুক্তি এই খাতের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে, যা ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্যই নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *