অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে সরকারকে এখনই দৃঢ় হতে হবে
ইমরান হোসেন মিলন: দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, অর্থনীতি ও জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু এই দ্রুতবর্ধনশীল বাজারের আড়ালে গড়ে ওঠেছে একটি ভয়ংকর অন্ধকার জগত, অবৈধ বা আনঅফিশিয়াল মোবাইল ফোনের বাজার। এই বাজার শুধু দেশীয় উৎপাদনকে বিপদে ফেলছে না, সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমিয়ে দিচ্ছে। অফিসিয়াল নয়, অবৈধ মোবাইল ফোনের বাজার শুধু শিল্প নয়, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ও বিনিয়োগের জন্যও বড় হুমকি।
অবৈধ মোবাইল ফোনের বাজার বিশাল ও নিয়ন্ত্রণহীন
আগের ‘বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’ যা বর্তমানে ‘বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাক্চারিং অ্যাসোসিয়েশন’ নামে পরিচিত তারা বলছে, দেশে বিক্রি হওয়া হ্যান্ডসেটের প্রায় ৬০ শতাংশই অবৈধ বা আনঅফিশিয়াল। এসব ফোন পাচার বা গ্রে চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আসে, কাস্টমস শুল্ক বা কর কিছুই দেয় না। ফলে সরকার বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে প্রকৃত অংক এর চেয়ে ঢের বেশি।
ডিজিটাল চেকিং সেবা বা “আপনার ফোন বৈধ কি না”- এই যাচাই পদ্ধতি সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে
এই মোবাইল ফোনগুলো মূলত বিদেশে পুনর্বিক্রিত বা ক্লোন আইএমইআই (IMEI) ব্যবহার করা ডিভাইস, যা এখানে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে বিক্রি হয়। এগুলোর মূল্য কম হওয়ায় অনেক ক্রেতা অজান্তেই প্রতারিত হন। এতে বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আর অবৈধ সিন্ডিকেট অঢেল মুনাফা করছে।
দেশীয় উৎপাদনের পথে বড় বাধা
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭টিরও বেশি স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা সক্রিয়। ওয়ালটন, স্যামসাং, ইনফিনিক্স, টেকনো, শাওমি, রিয়েলমি, অপো সব বড় ব্র্যান্ডই স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন তৈরি করছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অবৈধ ফোনের দৌরাত্ম্যে স্থানীয় শিল্প টিকে থাকতে পারছে না। এসব কারখানা শুল্ক ও কর দেয়, শ্রমিক নিয়োগ দেয়, উৎপাদন ব্যয় বহন করে। অপরদিকে অবৈধ মোবাইল ফোন বিক্রেতারা কোনও খরচ ছাড়াই বাজার দখল করে নিচ্ছে। এমন অবস্থায় বৈধ কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হচ্ছেন।
সম্প্রতি খবর এসেছে, কিছু অবৈধ বিক্রেতা একজোট হয়ে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানিকে বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিগত সরকারের ‘দোসর’ ট্যাগ দিয়ে এই শিল্পকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। এতে শুধু শিল্প নয়, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
বৈধ মোবাইল ফোন মানে ওয়ারেন্টি, নিরাপদ সফটওয়্যার ও সার্ভিস সুবিধা
সরকারের উদ্যোগ আশার আলো
এই বাস্তবতায় সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইএর) সিস্টেম আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে চালু হবে। এই সিস্টেম চালু হলে অবৈধ বা অননুমোদিত মোবাইল ফোন দেশের কোনও মোবাইল নেটওয়ার্কে কাজ করবে না। ভবিষ্যতে বিক্রি হওয়া সব মোবাইল ফোনকেই এই রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে হবে।
এনইআইআর প্রতিটি ফোনের আইএমইআই নম্বর যাচাই করবে। অবৈধ বা ক্লোন মোবাইল ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্লক হয়ে যাবে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যেই এ ধরনের সিস্টেম সফলভাবে চালু করেছে। পাকিস্তানে এই ব্যবস্থার ফলে ৫০ লাখের বেশি অবৈধ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক থেকে বাদ পড়েছে এবং বৈধ আমদানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশেও একইভাবে কার্যকর হলে সরকার রাজস্ব পাবে, স্থানীয় শিল্পে সমান প্রতিযোগিতা তৈরি হবে এবং সাইবার অপরাধ রোধে সহায়ক হবে।
অবৈধ মোবাইল ফোনের বাজার শুধু শিল্প নয়, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ও বিনিয়োগের জন্যও বড় হুমকি
কেন এখনই প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ
কয়েকটি কারণে সরকারকে এখনই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে রাজস্ব সুরক্ষা। অবৈধ ফোনের কারণে বছরে হাজার কোটি টাকা হারাচ্ছে সরকার। দেশীয় শিল্পের টিকে থাকতে ও বৈধ কারখানাগুলো সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ পাবে। ভোক্তার নিরাপত্তা দিকটাও জরুরি। কেননা বৈধ মোবাইল ফোন মানে ওয়ারেন্টি, নিরাপদ সফটওয়্যার ও সার্ভিস সুবিধা। সাইবার অপরাধ রোধেও এটি জরুরি। কেননা অননুমোদিত মোবাইল ফোন প্রায়ই প্রতারণা ও চুরি কাজে ব্যবহৃত হয়। এনইআইআর চালু হলে এই চারটি ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ভবিষ্যতে বিক্রি হওয়া সব মোবাইল ফোনকেই এনইআইআর-এর আওতায় আনতে হবে
বাস্তবায়নে রয়েছে চ্যালেঞ্জ
তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় থাকা এই ব্যবসা বন্ধ না হলে কোনও উদ্যোগই টেকসই হবে না। দ্বিতীয়ত, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, ভোক্তারা যেন সহজে আইএমইআই যাচাই করে বুঝতে পারেন মোবাইল ফোনটি বৈধ কি না। তৃতীয়ত, সমন্বয় দরকার অপারেটর, কাস্টমস ও এনবিআরের মধ্যে, যাতে অবৈধ মোবাইল ফোন প্রবেশের সুযোগ না পায়।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রাধিকার দিতে হবে কয়েকটি বিষয়ে। যার অন্যতম হলো আইনি কাঠামো। অবৈধ মোবাইল ফোন আমদানি ও বিক্রির শাস্তি কঠোর করতে হবে। স্থানীয় শিল্পে প্রণোদনা দিতে হবে। বৈধ কারখানাগুলোর জন্য কর রেয়াত, সহজ ঋণ বা ইনসেনটিভ চালু করা যেতে পারে। ডিজিটাল চেকিং সেবা বা “আপনার ফোন বৈধ কি না”- এই যাচাই পদ্ধতি সবার জন্য সহজলভ্য করতে হবে।
সবশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ আজ স্মার্টফোননির্ভর অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করেছে। ই-কমার্স, ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্স সব কিছু এখন মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক। এই বাস্তবতায় অবৈধ মোবাইল ফোনের দৌরাত্ম্য কেবল রাজস্ব ক্ষতি নয়, দেশের প্রযুক্তি নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। তাই এখনই সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ দরকার। এনইআইআর বাস্তবায়ন কেবল একটি প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নয়, এটি অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠারও লড়াই। অবৈধ সিন্ডিকেটের চাপ উপেক্ষা করে যদি সরকার এটি সফলভাবে কার্যকর করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ সত্যিই হয়ে ওঠবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী মোবাইল উৎপাদন ও প্রযুক্তি কেন্দ্র।
লেখক: ইমরান হোসেন মিলন, মিডিয়া পেশাজীবী





