অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে এনইআইআর: ডিজিটাল শৃঙ্খলা
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): দেশের টেলিযোগাযোগ এবং ডিজিটাল অর্থনীতিক্ষেত্রে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা নির্মূল করতে এবং বর্ধিত ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে এক দুর্বার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার বা NEIR ব্যবস্থা কার্যকর করার চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হলো শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে দেশে প্রবেশ করা মোবাইল ফোনগুলোর নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা, যা সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সুরক্ষিত করবে এবং জালিয়াতির মূল শেকড় উপড়ে ফেলবে। এই যুগান্তকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে কেবলমাত্র কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত, মানসম্মত ও বৈধভাবে আমদানি বা উৎপাদিত মোবাইল ফোন ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
অর্থনীতিতে অবৈধ চোরাচালানের বিধ্বংসী ক্ষত
মোবাইল ফোন বাজার বর্তমানে এক মারাত্মক আর্থিক অসামঞ্জস্যের শিকার। দেশের প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বিশাল মোবাইল ফোন বাজারের একটি বৃহৎ অংশ, যা বিভিন্ন তথ্যমতে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি, তা চোরাচালানকৃত বা নকল ডিভাইসের কব্জায়। এই অবৈধ বা ‘কালোবাজার’ জাতীয় অর্থনীতিতে এক গভীর আঘাত হানছে।
বিরাট রাজস্ব ক্ষতি: শুল্ক ফাঁকির কারণে সরকারি কোষাগার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা অতিক্রম করে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, বছরে এই ভয়ংকর ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম ৫০০ কোটি টাকা।
দেশীয় শিল্পের বিপর্যয়: দেশের মোবাইল ফোন সংযোজন ও উৎপাদন খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থাকলেও, অবৈধ ডিভাইসের অস্বাভাবিক মূল্য প্রতিযোগিতার মুখে দেশীয় উৎপাদনকারী ১৮টি প্রতিষ্ঠান চরম সংকটে পড়েছে। এই শিল্প সংস্থাগুলো জানিয়েছে, অবৈধ পণ্যের দাপটে তাদের উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩০ শতাংশ) অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকছে।
বৈশ্বিক বিজয়: টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক সাফল্য তুলে ধরে বলেছেন, উজবেকিস্তান এনইআইআর সফলভাবে প্রয়োগ করে তাদের রাজস্ব আয় সাত গুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থা আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে।
ডিজিটাল প্রতিরক্ষা: অপরাধের প্রধান প্রবেশপথ বন্ধ
এনইআইআর কেবল অর্থনৈতিক সুরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও এক বিশাল পরিবর্তন আনবে। অবৈধ ডিভাইসগুলোই মূলত বিভিন্ন সাইবার ও আর্থিক অপরাধের প্রধান আশ্রয়স্থল।
জালিয়াতির মূলোচ্ছেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন (২০২৪) অনুযায়ী, দেশে সংঘটিত মোট ডিজিটাল প্রতারণার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭৩ শতাংশ) সংঘটিত হয় অনিবন্ধিত ডিভাইস এবং অবৈধ সিম ব্যবহার করে। এনইআইআর-এর মাধ্যমে এই ধরনের ডিভাইসের ব্যবহার বন্ধ হলে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সংক্রান্ত প্রতারণা বা সিম জালিয়াতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
অপরাধী চিহ্নিতকরণ: প্রতিটি হ্যান্ডসেটের IMEI নম্বরকে গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে কঠোরভাবে সংযুক্ত করা হবে। ফলে চুরি বা হারিয়ে যাওয়া ফোন খুব সহজে শনাক্ত এবং নেটওয়ার্কে সম্পূর্ণভাবে ব্লক করা যাবে, যা অপরাধ দমনে সহায়ক হবে।
এনইআইআর কেবল অর্থনৈতিক সুরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও এক বিশাল পরিবর্তন আনবে
কার্যপদ্ধতি ও গ্রাহকের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা
পুরোনো ব্যবহারকারীর স্বস্তি: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫-এর আগে দেশের নেটওয়ার্কে সচল থাকা সব মোবাইল ফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে যাবে। ব্যবহৃত ফোনের বর্তমান অবস্থা জানতে যেকোনও সময় *১৬১৬১# ডায়াল করে যাচাই করা যাবে।
নতুন ডিভাইস যাচাই: নতুন ফোন (বিক্রয় কেন্দ্র বা অনলাইন থেকে কেনা) কেনার আগে গ্রাহকদের তার বৈধতা অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে। ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে KYDIMEI নম্বরটি লিখে ১৬০০২ নম্বরে পাঠাতে হবে। নিবন্ধনের ফলাফল অবৈধ ফোনের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সতর্ক করে ত্রিশ দিনের জন্য নেটওয়ার্কে সংযুক্ত রাখা হবে, এরপর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্ন হবে।
বিদেশ থেকে আনীত ফোনের বিশেষ প্রক্রিয়া: বিদেশে কেনা বা উপহার হিসেবে পাওয়া ফোন শুল্ক এবং ব্যাগেজ রুলস মেনে দেশে আনলে সেগুলোর জন্য একটি বিশেষ নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে। এই ফোনগুলো প্রথমে সচল থাকবে, তবে গ্রাহককে ত্রিশ দিনের মধ্যে অনলাইনে (neir.btrc.gov.bd) গিয়ে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র জমা দিতে হবে।
মোবাইল ফোন হস্তান্তর: নিবন্ধিত হ্যান্ডসেট বিক্রি বা অন্য কারও কাছে দেয়ার আগে গ্রাহককে অবশ্যই ডি-রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। এই প্রক্রিয়া Citizen Portal বা *১৬১৬১# ডায়াল করে করা যাবে।
নীতিমালা ও অংশীজনদের বিশ্লেষণ: আগামীর পথনির্দেশ
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “এনইআইআর সিস্টেম চালু হলে দেশের নেটওয়ার্কে নিবন্ধনবিহীন কিংবা আনঅফিশিয়াল ফোনের ব্যবহার বন্ধ হবে। পাশাপাশি অবৈধভাবে আমদানিকৃত বা নকল মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হবে। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে এবং দেশীয় মোবাইল উৎপাদন শিল্প আরও সুরক্ষিত হবে। বৈধ ও অবৈধ হ্যান্ডসেট সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, চুরি বা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত ডিভাইস শনাক্ত ও ব্লক করা সম্ভব হওয়ায় অপরাধ দমনেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”

তিনি আরও বলেন, “এনইআইআর শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নয়। এটি নাগরিকের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা এবং টেলিযোগাযোগ খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার একটি জাতীয় অঙ্গীকার। এনইআইআর চালুর ফলে এমএফএস জালিয়াতি, সিম প্রতারণা ও স্ক্যাম কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে ইকেওয়াইসি যাচাই আরও শক্তিশালী হবে, টেলিকম সেক্টরে নিরাপত্তা জোরদার হবে এবং রাজস্ব আদায়ও বৃদ্ধি পাবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিটিআরসির পাশাপাশি গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক এবং টেলিটক তাদের নিজস্ব ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (ইআইআর) সিস্টেম উন্নয়নে কাজ করছে।”
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদুল উল বারী বলেন, এনইআইআর- এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মোবাইল হ্যান্ডসেট ও সিম সংক্রান্ত জালিয়াতি সহজে সনাক্ত করা যাবে এবং স্মার্টফোন ব্যবহার বাড়াতে কার্যক্রম নেয়া হবে। রাষ্ট্রীয় ও গ্রাহক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং সিমের মাধ্যমে প্রতারণা, আর্থিক লেনদেন জালিয়াতি কমে আসবে।
বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রি. জে. মো. আমিনুল হক জানান, টাওয়ারের অধীনে হ্যান্ডসেটে যুক্ত সিমগুলো হোয়াইট, ব্ল্যাক, গ্রে ও রোমিং ক্যাটাগরিতে বিন্যস্ত হবে। এনইআইআর চালু হওয়ার আগের সব সেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিমের বিপরীতে নিবন্ধিত হবে। এতে ক্লোন ও অবৈধ ফোনও নিবন্ধিত হয়ে যাবে। পরবর্তী সময়ে ওই ফোন কাউকে দিতে ডিরেজস্ট্রেশন করা হবে। বিটিআরসি পুরো বিষয়টির তদারকি করবে। আর মোবাইলের বৈধতা যাচাইয়ে ১৬০০২ ও নিবন্ধনের জন্য ১৬১৬১ এ মেসেজ পাঠাতে হবে।
উৎপাদনকারী এবং মোবাইল অপারেটর সংস্থার প্রত্যাশা এনইআইআর দেশীয় শিল্পের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে মোবাইল অপারেটররা অটল থাকবে এবং ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন (২০২৪) অনুযায়ী, দেশে সংঘটিত মোট ডিজিটাল প্রতারণার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭৩ শতাংশ) সংঘটিত হয় অনিবন্ধিত ডিভাইস এবং অবৈধ সিম ব্যবহার করে
এক নজরে আপনার অবশ্য করণীয়
নতুন ফোন ক্রয়ে: বৈধতা যাচাই করুন: KYD পাঠিয়ে দিন ১৬০০২ নম্বরে।
পুরাতন ফোনের স্ট্যাটাস: ডায়াল করুন: *১৬১৬১#
দ্রুত সহায়তার জন্য: NEIR সম্পর্কিত যেকোনও জিজ্ঞাসা বা সহায়তার জন্য বিটিআরসি’র হেল্পডেস্ক নম্বর ১০০ অথবা মোবাইল অপারেটরগণের কাস্টমার কেয়ার নম্বর ১২১ এ যোগাযোগ করা যেতে পারে।
এনইআইআর ব্যবস্থার এই আনুষ্ঠানিক সূচনা বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ও ডিজিটাল আর্থিক খাতে এক ঐতিহাসিক মোড়। সরকারের নীতিমালার সার্থক বাস্তবায়ন, বিটিআরসি’র কঠোর পর্যবেক্ষণ এবং অংশীজনদের (অপারেটর ও উৎপাদক) সমন্বিত সহযোগিতার মাধ্যমেই এই মহাযজ্ঞ সফল হতে পারে। একদিকে যেমন বিপুল রাজস্ব লুণ্ঠন চিরতরে বন্ধ হবে, তেমনি অন্যদিকে ডিজিটাল লেনদেন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকের নিরাপত্তা হবে সর্বোচ্চ স্তরে। ১৬ ডিসেম্বরের পর দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হয়ে শুধুমাত্র বৈধ হ্যান্ডসেট ব্যবহার করা এবং দেশের ডিজিটাল শৃঙ্খলা বজায় রাখার এই মহৎ উদ্যোগে শরিক হওয়া।





