সফটওয়্যার সাম্প্রতিক সংবাদ

সব ব্যাংকে দেশীয় সফটওয়্যার নিশ্চিতের তাগিদ

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছরেই দেশের সব ব্যাংকে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন দেশের তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, সরকার আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সফটওয়্যার রপ্তানি করে ৫০০ কোটি ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও বেশির ভাগ ব্যাংক এখনো বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। দেশে এখন ৬৩টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশেই বিদেশি কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহার হয়। দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার হয় বাকি ৪০ শতাংশে। বিদেশি সফটওয়্যারের ওপর কেন ব্যাংক কর্মকর্তাদের এত ঝোঁক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

উল্লেখ্য, কোর ব্যাংকিং সেবা বলতে বোঝানো হয়-এক অ্যাকাউন্টের সেবা সবখানে। কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো স্থান থেকেই অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সব ধরনের লেনদেন করা যায়।

একাধিক তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জানতে চেয়েছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত একাধিক ব্যাংক কেন বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্ট করে বলা আছে, দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করতে।

দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬৩টি। এখানে কোর ব্যাংকিংয়ে স্থানীয় সফটওয়্যার ব্যবহার হয় ৪০ শতাংশ। আর বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার হয় ৬০ শতাংশ। অথচ ভারতে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৫১টি। সেখানে কোর ব্যাংকিংয়ে স্থানীয় সফটওয়্যার ব্যবহার হয় ৯২ শতাংশ। আর বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার হয় মাত্র ৮ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমরা সরকার থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছি, যা অব্যাহত থাকবে। আমাদের সরকারি-বেসরকারি খাতের কোলাবরেশন যদি আরও জোরদার হয়, তাহলে আমাদের সফটওয়্যার খাতের কাজ দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই পূরণ করা সম্ভব। আমাদের ব্যাংকিং খাতের গত ১১ বছরের উন্নয়নের পর এখন পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। ব্যাংক এখন পকেটে, হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আমাদের ব্যাংকিং সলিউশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগডেটা অ্যানালিসিস, ব্লক চেইনের মতো প্রযুক্তির সমাধান দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি বেশি আনতে হবে। দেশীয় সফটওয়্যার শিল্পের সুরক্ষায় আপনাদের পরামর্শ আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাব। তিনি ঘোষণা দেন, যারা দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করছে তাদের কর হার কমাতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবেন। আর যারা বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তাদের করহার বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করবেন।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমরা বিদেশি কোনো জিনিস পেলেই গর্বিত হয়ে যাই। দেশে এখন ব্যাংকের সাড়ে দশ হাজার শাখা আছে। আমরা এখনো ব্যাংকে বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছি। দেশীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করছি না। বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে বছরে আমাদের ৫০০ কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দেশের বাইরে পাঠাতে হচ্ছে। অথচ এই টাকা দিয়ে আমাদের দেশে অসংখ্য যুবকের চাকরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মধ্যে জার্মান সৈন্য অত্যন্ত চৌকস; তাই বলে কি আমরা আমাদের সীমান্তে জার্মান সৈন্য নিয়োগ দেব?’ ওয়ালটনসহ বাংলাদেশের তৈরি সব পণ্য ব্যবহার করতে ব্যাংকারদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সিটিও ফোরামের সভাপতি তপন কান্তি সরকার বলেন, ‘৩১টি ব্যাংক এখন দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা গেছে, একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বিদেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। অথচ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার আছে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন, বিদেশি সফটওয়্যারের চেয়ে দেশি সফটওয়্যার অনেক বেশি সক্ষম। দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে সেবাও মেলে খুব দ্রুততার সঙ্গে।

সীমান্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুখলেসুর রহমান বলেন, আমি একসময় মনে করতাম, বিদেশি সফটওয়্যার ভালো। মাথায় তখনো আসেনি দেশীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার এত দূর এগিয়েছে। আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। আমরা যখন কোনো কিছু কিনতে যাই, আমাদের ঝোঁক থাকে বিদেশি পণ্যের দিকে। আমরা সীমান্ত ব্যাংক গত তিন বছর চার মাসে ৭০ হাজার অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত আমাদেরকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সন্তোষজনক। ওরাকলের সফটওয়্যার ব্যবহারের সময় কোনো সমস্যায় পড়লে তা রক্ষণাবেক্ষণে অনেক সময় অপচয় হয়। কিন্তু দেশীয় পণ্য কিনলে দ্রুততার সঙ্গে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়।

ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদেশি সফটওয়্যারের চেয়ে দেশি সফটওয়্যার ব্যবহার অধিক সাশ্রয়ী। দেশি সফটওয়্যারে লাইসেন্স ফি বাবদ খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা, বিদেশি সফটওয়্যারে এই খরচ ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা। বিদেশি সফটওয়্যারের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ (এএমসি) খরচ চার থেকে ছয় কোটি, আর দেশি সফটওয়্যারে তা তিন থেকে চার কোটি টাকা। বিদেশি সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে কাস্টমাইজেশনে প্রতিদিন বিদেশিরা ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়, সেখানে দেশীয় সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে এই খরচের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া বিদেশি সফটওয়্যারে বাস্তবায়ন খরচ আরো ১৮ থেকে ২৫ কোটি টাকা, সেখানে দেশি সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে মাত্র তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা।

আমাদের দেশ একটা সময় সফটওয়্যার রপ্তানি করবে, এটা ছিল স্বপ্নের মতো। তবে দিন পাল্টেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে দেশে এসে তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাচ্ছে। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে পোশাক খাতকে। অন্যদিকে সফটওয়্যার রপ্তানিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। সফটওয়্যার রপ্তানিতে একসময় ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। তবে আশার খবর হলো, সফটওয়্যার রপ্তানিতে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *